ভাঙচুর চালানো হচ্ছে চোলাইয়ের ভাটিতে। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে।—নিজস্ব চিত্র।
রাত নামলেই ওদের বুক কাঁপত।
একটু বাদেই টলতে টলতে আসবে লোকটা। ঘোলাটে দু’চোখ, তীব্র বদ গন্ধ, জড়ানো গলা, গালিগালাজ।
ঘরে চাল চড়ে না। স্কুলের বইখাতা কেনার পয়সা জোটে না। মায়ের পরনে ছেঁড়া শাড়ি। লোকটার কিস্যু যায়-আসে না।
ঘরে ফিরলেই অশান্তি। মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি। তার পরেই মাকে ধরে বেদম মার। আর মায়ের ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কান্না...
রোজ। রোজ।
সহ্য হয় না আর। ঠিক মতো জ্ঞান হওয়ার আগেই লোকটাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে শিখিয়ে দিয়েছিল কে যেন। হয়তো মা-ই। এখন আর ইচ্ছে করে না। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে। পেটের ভেতর থেকে গলা পর্যন্ত পাক দিয়ে উঠতে থাকে অন্ধ রাগ...
সেই রাগেই বাড়ি থেকে খালি পায়ে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল দুই ভাই। অজয় আর জয়। প্রথম জন ষষ্ঠ শ্রেণি, জয় এক ক্লাস নীচে।
বেরিয়ে এসেছিল সীতম, বিষ্ণু, মামনি, রবীন... সব এক অবস্থা। কিছু একটা করতেই হবে। দিনে যখন বাবা সুস্থ, ওরা হাতে-পায়ে ধরে বুঝিয়েছে। লোকটা মাথাও নেড়েছে বাধ্য ছেলের মতো। রাত হতেই ফের যে-কে-সেই।
রাস্তা তা হলে একটাই। বিষদাঁতের গোড়াটাই উপড়ে দিতে হবে। গ্রামেই আট-ন’টা চোলাই মদের ভাটি। সকাল-সন্ধে লোকে গিয়ে মদ গিলছে। সব ভেঙে দিতে হবে। যে ভাবেই হোক!
মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে ভূমিহর গ্রামটা এমনিতে বাংলার আর পাঁচটা গ্রামের মতোই। রাজমল্লদের পাড়ায় সন্ধেয় তুলসীতলায় পিদিম জ্বলে। ধুলো মাখা পায়ে ছুটতে-ছুটতে বাড়ি ঢোকে জয়-অজয়, বিষ্ণু-সুজয়েরা। মায়ের কড়া নিয়ম, শাঁখ বাজার আগে চৌকাঠে পা রাখতে হবে। বাতি জ্বেলে বসে যেতে হবে পড়তে। ওরা কেউ এর অন্যথা করে না।
কিন্তু সাঁঝ গড়ালেই যে রাত আসে.. আর আসে একটা লোক, টলতে টলতে...
জয়ের কথায়, “বাবা গালিগালাজ করতে থাকে। মা চাপা গলায় বলে, ‘চুপ করো, ছেলেরা পড়ছে।’ তাতে আরও খেপে উঠে মাকে ধরে পেটাতে থাকে বাবা। কখনও কখনও পালিয়ে গিয়েছি বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু সেখানেও তো সেই একই অশান্তি। এক ঘটনা!”
‘‘সুস্থ অবস্থায় বাবাকে বহু বুঝিয়েছি, কোনও লাভ হয়নি। এখনও দু’-তিনটে বই কিনতে পারিনি। বন্ধুদের থেকে বই চেয়ে আর কত দিন চালানো যায়। মনে হচ্ছিল, আর বোধহয় স্কুলে পড়াই হবে না”, বলতে বলতে কেঁদেই ফেলে নবম শ্রেণির সুজয় রাজমল্ল।
সুজয়েরই সহপাঠী রবীন রাজমল্ল তো ঠিকই করে ফেলেছিল, আত্মহত্যা করবে। বাড়ি থেকে পালিয়েও যায়। রবীনের কথায়, “কোন ছেলে দাঁড়িয়ে দেখবে যে তার মাতাল বাবা মাকে ধরে মারছে। কিন্তু মরতে গিয়েও মায়ের জন্যই পারিনি। গভীর রাতে ফিরে আসি। দেখি, মা না খেয়ে জেগে বসে আছে।’’
নবম শ্রেণিতেই পড়ে সীতম। তার দাদা বিষ্ণু রাজমল্ল সামনের বার শেখদিঘি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক দেবে। ওদের বাবা দিনমজুরের কাজ করে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত মদে চুর। ‘‘বাবাকে আমরা দু’ভাই বহু বার বুঝিয়েছি, মদ খেয়ে ঘরে এলে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। শুনে উল্টে আমাদের উপরেই চড়াও হয়েছে। কে করবে পড়াশোনা?”
স্কুল-পড়ুয়া মামনি রাজমল্লের বাবা মদ খান না। কিন্তু পাশেই বেহেড মাতালের আস্তানা। সন্ধের পর থেকে হল্লা, গালিগালাজ, মারধর শুরু হয়ে যায়। ‘‘বেশ কয়েক বার বাবা গিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। উল্টে তেড়ে বাবাকেই মারতে আসে”, গোমড়া মুখে বলে মামনি।
পাশের জেলা বীরভূমে নলহাটি কলেজে পড়েন তাপস রাজমল্ল। তাঁর আক্ষেপ, “চোলাইয়ের অভিশাপে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা। প্রায় দু’শো ছাত্রছাত্রী রয়েছে গ্রামে। কিন্তু রাত নামলেই পড়া শেষ।’’
মেয়েরা ঝাঁটাপেটা করে গাঁয়ের চোলাই ভাটি চাটি করে দিয়েছে, এমন নজির এ রাজ্যে কম নেই। পাড়ার মোড়ে নিয়তি রাজমল্ল বলেন, “আমার স্বামী ভাগ্য রাজমল্ল চোলাই খেয়েই অকালে মরেছে। ছেলে জয়হিন্দও এক রাস্তা ধরেছে!’’ শেফালি রবিদাস জানান, তাঁদের সংসারে রোজগারের ১০০ টাকার মধ্যে ৪০ টাকা মদের পিছনেই চলে যায়। ‘‘সংসারে অভাব তো দিন দিন বাড়ছে’’, ঝাঁঝিয়ে ওঠেন পঞ্চমী রাজমল্ল।
কিন্তু তাঁরা নন। ভূমিহর গ্রামে বরং মায়েদের চোখের জল মোছাতে রাস্তায় নেমেছে ছেলেমেয়েরাই। জয়, অজয়, সীতম, মামনি, রবীন... আরও কত! শতাধিক স্কুল পড়ুয়া। সঙ্গে বিশাল রাজমল্ল, তাপস রাজমল্লদের মতো কলেজ পড়ুয়ারাও। গত দু’সপ্তাহ ধরে গাঁয়ের সব কথা চোলাইয়ের ঠেক একে-একে ভেঙে দিয়েছে তারা।
দিয়েছে বটে। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারেনি।
দু’দিন সব ঠিকঠাক। তার পরেই ফের চোরাপথে ভূমিহরে ঢুকতে শুরু করেছে চোলাই। সাগরদিঘি কলেজের ছাত্র বিশাল বলেন, “ভাটি ভাঙা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই ভাটি মালিকেরাই এখন বোতলে চোলাই ভরে ব্যাগে লুকিয়ে গ্রামে আনছে।’’ শ’দুয়েক গ্রামবাসী ও ছাত্রছাত্রী মিলে সই করে সাগরদিঘি থানায় অভিযোগ জমা দিতে গিয়েছিলেন তাঁরা। বিশালের ক্ষোভ, ‘‘পুলিশ আবগারি দফতরে যেতে বলে আমাদের লিখিত অভিযোগ ফিরিয়ে দেয়। আমরা রঘুনাথগঞ্জে আবগারি দফতরে গেলাম। ওরা বলল, সাগরদিঘি ওদের এলাকার মধ্যে পড়ে না!” গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য কাজল রাজমল্লের আক্ষেপ, ‘‘চোলাই বন্ধের কাজটা তো করা উচিত ছিল পুলিশ ও আবগারি দফতরের। ওরা কোনও সহযোগিতাই করছে না।”
আবগারি দফতরের জেলার সুপার দেবাশিস বিশ্বাস ফোন ধরেননি। মোবাইলে মেসেজ করা হলেও উত্তর দেননি। আর সাগরদিঘি থানার ওসি অসিতকুমার দে-র দাবি, “কিছু দিন আগেই আমরা অভিযান চালিয়ে ওই গ্রাম থেকে কয়েক জনকে গ্রেফতার করেছি।’’
কর্তারা নির্বিকার থাকায় উল্টে এখন রক্তচক্ষু দেখাতে শুরু করেছে চোলাই ভাটির মালিক আর তাদের পোষা লোকজনেরা। রাস্তাঘাটে ছাত্রছাত্রীদের দেখতে পেলেই খুন করার হুমকি দিচ্ছে। ‘মেরে ফেলব’, ‘কেটে ফেলব’ বলে হাঁসুয়া নিয়ে তাড়া করছে। বাধ্য হয়ে গরমের ছুটিতে দুপুর বেলাতেও একা গ্রামের রাস্তায় বেরোচ্ছে না সীতম-রবীনেরা। যেখানেই যাচ্ছে, কয়েক জন এক সঙ্গে দল বেঁধে যাচ্ছে।
মায়েরা ভয় পাচ্ছেন না?
বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কালিদাসী রাজমল্ল বলেন, “স্বামীর মদ ছাড়াতে আমিই ছেলেদের পথে নামতে বলেছি। ওরা যা করছে, ঠিক করছে।”
কালিদাসী, নিয়তি, শেফালিরা বলছেন, ‘‘আমরা কিছু করতে পারিনি। ছেলেমেয়েরাই ঢিট করবে। দেখি না, জল কদ্দুর গড়ায়...।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy