কতই বা বয়স ওদের!
কারও আট মাস, কারও ১০, কেউ বছর দুয়েকের, কেউ বা একটু বেশি।
এই বয়সেই ওরা মাতৃহারা। বাবা থেকেও নেই বেশির ভাগেরই!
কোথায় হাসি-খেলা! এই বয়সেই ওরা দেখে নিয়েছে মায়ের পোড়া বা ঝুলন্ত মৃতদেহ।
পণপ্রথা কী, ওদের জানার কথা নয়। কী কারণে তাদের মায়ের ওই পরিণতি, তা বোঝারও বয়স হয়নি। আধো গলায় সে দিন দেগঙ্গার কুমরুলির দু’বছরের আশিক বিল্লা বলে, ‘‘মাকে মেরে ফেলেছে বাবা!’’ কিন্তু কেন? নেই উত্তর। এখনও সমাজ থেকে নির্মূল হয়নি ওই প্রাচীন প্রথা। আর তার শিকার শুধু ‘ঘরের বধূ’ই হচ্ছেন না, আঁচ লাগছে একরত্তি সন্তানদেরও। কুমরুলির আশিক, দেগঙ্গার ইমরান বা শাসনের সায়নের মতো রাজ্যের বহু শিশু আচমকা ‘অনাথ’ হয়ে চলেছে বছরের পর বছর।
বছর দুয়েকের ইমরান এখনও বলে ওঠে, ‘‘আগুন, কত্ত আগুন! সব পুড়ে গেল...!’’ মাসতিনেক আগে দেগঙ্গায় ঘরের মধ্যে সেই আগুনেই মা রাহেনা পরভিনকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ছটফট করতে দেখেছে ইমরান। সেই স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেনি সে। স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে আগুনে জখম হয়েছিলেন রাহেনার স্বামী জাকির হোসেন। তিনি এখনও চিকিৎসাধীন।
মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই ইমরান হাড়োয়ায় মামার বাড়িতে থাকে। রাহেনার বাবা নুরউজ্জামান খানের অভিযোগ, পণের দাবিতে মেয়ের উপর অত্যাচার করতেন শাশুড়ি। তিনিই রাহেনাকে পুড়িয়ে মারেন। ঘটনায় গ্রেফতার হয় শাশুড়ি। মেয়েকে হারিয়ে এখন ইমরানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন নুরউজ্জামান ও তাঁর স্ত্রী তহমিনা বিবি। তহমিনা বলেন, ‘‘কী যেন একটা ভয়ে ছেলেটা সব সময় কুঁকড়ে থাকে। চিৎকার করে, কাঁদে।’’ নুরউজ্জামানের চিন্তা, ‘‘বাচ্চাটাকে কে যে দেখবে!’’
আরও পড়ুন: আত্মঘাতী হয়েছেন অন্তরা, ইঙ্গিত দিচ্ছে ময়না-তদন্ত
আট মাসের সায়নের মতো মাতৃহারা একটি ‘দুধের শিশু’কে নিয়ে কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না শাসনের সুমন মণ্ডলও। দেগঙ্গার ব্যবসায়ী মৃত্যুঞ্জয় মল্লিকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সুমনের দিদি সীমার। গত জুনে একদিন দিদির বাড়িতে গিয়েছিলেন সুমন। পরের দিন ভোরে দেখেন, ঘরের মধ্যে জ্বলছেন সীমা। বাইরে দরজা বন্ধ করে তাঁর জামাইবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে অভিযোগ! এ ক্ষেত্রেও শিশুটি মায়ের মৃত্যুর সাক্ষী। পণ না-মেলায় খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হন সীমার শ্বশুর-শাশুড়ি। মৃত্যুঞ্জয় এখনও পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’। শিশুটিকে সুমনদের হাতে তুলে দেয় পুলিশ।
এমন সব ঘটনায় শিশুগুলি অনেক ক্ষেত্রে মানসিক বিকৃতির শিকার হয় বা তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে বলে মনে করছেন বারাসত জেলা হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মৌমিতা মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘‘আশপাশের পরিবেশ থেকে হেনস্থা, চাপ, মা-বাবার স্নেহের অভাব, সব মিলিয়ে শিশুটি গুটিয়ে যায়।’’ মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাবা-মা সাধারণত শিশুদের কাছে রোল মডেল হন। তবে এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের উপরে শিশুদের একটা স্বাভাবিক রাগ জন্মায়। ওদের মানিয়ে নিতে খুব সমস্যা হয়। এখানেই দাদু-দিদা এবং পরিজনদের দায়িত্ব অনেকটা বেড়ে যায়। দেখতে হবে বাবার দিকের আত্মীয়েরা মায়ের বিরুদ্ধে আর মায়ের দিকের আত্মীয়েরা বাবার বিরুদ্ধে সর্বক্ষণ নিন্দা না করে যান।’’
‘‘গত ছ’মাসে আশিক একবারও হাসেনি,’’— বলছেন তার দিদিমা, দেগঙ্গার হরপুকুরের সুন্দরী বিবি। কেন? ওই মহিলা জানান, পণের অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে তাঁর মেয়ে আমেনা বিবি কুমরুলির শ্বশুরবাড়ি থেকে ছেলে আশিককে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছিলেন। মাসছয়েক আগে যে দিন স্বামী নাসিরুদ্দিন আমেনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যান, তার পরের দিন শ্বশুরবাড়ির কাছের গাছে আমেনার ঝুলন্ত দেহ মেলে। খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হন তাঁর শ্বশুর। নাসিরুদ্দিন এখনও পলাতক।
তখন থেকেই মায়ের পথ চেয়ে মামার বাড়িতে দিন কাটছে আশিকের। তার মা যে আর ফিরবে না, কে বোঝাবে ছেলেটিকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy