Advertisement
০২ মে ২০২৪

তৃণমূলে কোন্দল সামলাচ্ছে অভিভাবক পুলিশ

নেতাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। বর্ধমানের বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও খুনোখুনি রুখতে তাই পুলিশকে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। গত কয়েক দিন ধরেই তৃণমূল নেতাদের থানায়-থানায় ডেকে বৈঠক করছে পুলিশ। শাসকদলের গোষ্ঠী-কোন্দলে যাতে এলাকা অশান্ত হয়ে না ওঠে, সে ব্যাপারে নেতাদের সতর্ক করা হচ্ছে।

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০৩:১৩
Share: Save:

নেতাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। বর্ধমানের বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও খুনোখুনি রুখতে তাই পুলিশকে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন।

গত কয়েক দিন ধরেই তৃণমূল নেতাদের থানায়-থানায় ডেকে বৈঠক করছে পুলিশ। শাসকদলের গোষ্ঠী-কোন্দলে যাতে এলাকা অশান্ত হয়ে না ওঠে, সে ব্যাপারে নেতাদের সতর্ক করা হচ্ছে। পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল শুধু বলেন, “কোনও রকম অশান্তি হলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বৈঠকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে।”

গত রবিবার রাতেই খণ্ডঘোষে তিন তৃণমূল কর্মী খুন হয়েছেন। প্রধান অভিযুক্ত স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির দলীয় কর্মাধ্যক্ষ মোয়াজ্জেম হোসেন। তাঁকে বহিষ্কার করা হলেও গোটা এক সপ্তাহে ধরা যায়নি। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণও করানো যায়নি। ফলে দলের জেলা নেতৃ়ত্বের উদ্দেশ্য ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

খণ্ডঘোষের ঘটনার পরেই জেলা পুলিশের তরফে উচ্চ মহলে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল, বর্ধমানের গ্রামীণ এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বাড়ছে। তার জেরে অন্য এলাকাতেও বড় গোলমাল বাধতে পারে। রায়না, মাধবডিহি, খণ্ডঘোষ, কেতুগ্রাম ও মন্তেশ্বরে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরমে। কাটোয়া, মেমারি, জামালপুর, মঙ্গলকোট, গলসি বা বর্ধমান শহরেও বড় গোলমালের আশঙ্কা রয়েছে।

পুলিশ সূত্রের খবর, এই রিপোর্ট যাওয়ার পরেই নবান্ন থেকে নির্দেশ আসে, যে সব জায়গায় গোলমালের আশঙ্কা রয়েছে, সেখানে সব গোষ্ঠীকে নিয়ে দ্বন্দ্ব মেটাতে হবে। ওই নির্দেশ পেয়ে বর্ধমানের পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল প্রতিটি থানাকে নির্দেশ দেন, তৃণমূলের সব গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে কোথায় কী সমস্যা রয়েছে তা জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

ইতিমধ্যেই কাটোয়া, মেমারি, রায়না, মাধবডিহি, বর্ধমান ও জামালপুর থানায় নেতাদের ডেকে বৈঠক হয়েছে। পূর্বস্থলী, মঙ্গলকোট, খণ্ডঘোষ-সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় তৃণমূল নেতাদের ফোন করে বৈঠকে ডাকা হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, বিধায়ক ও দলের পদাধিকারীরা রয়েছেন।

জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, কাদের ডাকা হবে, সেই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ওসি বা আইসি-দের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন কর্তারা। অনেক সময়ে ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসার বা সার্কেল ইন্সপেক্টরও বৈঠকে থাকছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তৃণমূল নেতারা পঞ্চায়েত দখল নিয়ে সমস্যার কথা বলছেন। দক্ষিণ দামোদর এলাকায় বালি খাদান থেকে তোলা আদায় নিয়ে কোন্দলের কথাও উঠে এসেছে।

প্রায় প্রত্যেকটি বৈঠকেই নেতাদের কথা শোনার পরে পুলিশের কর্তারা জানিয়েছেন, শাসকদলের লোকেদের জন্য যাতে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা না হয়, তা দেখার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নিজে পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা নেতৃত্বের নির্দেশ ছাড়া কোনও রাজনৈতিক কার্যকলাপ করা যাবে না। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে কোনও সমস্যা তৈরি হলে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গোষ্ঠী সংঘর্ষ হলে আগে তাঁদের ধরা হবে বলেও কিছু জায়গায় নেতাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছে পুলিশ।

যা দেখে বিরোধী দলগুলি প্রশ্ন তুলছে, শাসকদলের ঘরোয়া কোন্দল মেটানোও কি এখন পুলিশের কাজের মধ্যে পড়ে? বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা তথা জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক অমল হালদারের টিপ্পনী, “তৃণমূলের দ্বন্দ্ব তো আদতে তোলা আদায় নিয়ে।

তা মেটাতে পারলে তোলার

টাকার ভাগ পাবে না বলেই কি পুলিশের এত উৎসাহ?’’

পুলিশ ‘অভিভাবক’ হয়ে বসায় খুশি নন তৃণমূলের বহু নেতাও। থানায় বৈঠক সেরে বেরিয়ে একাধিক নেতাকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘দেখে-শুনে তো মনে হচ্ছে ওসি-ই যেন দলের নেতা!’’ নেতাদের জায়গা পুলিশকে নিতে হচ্ছে কেন? তবে কি তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে গিয়েছে? দলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) তথা রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ অবশ্য বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, “পুলিশ কী করছে তা আমার জানা নেই।

তবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মেটাতে আমরা বৈঠক করছি। প্রয়োজনে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।”

স্বপনবাবু এড়ানোর চেষ্টা করলেও পূর্বস্থলীর (উত্তর) তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ও স্বীকার করেন, থানায় এ রকম একটি বৈঠকে থাকার জন্য পুলিশ তাঁকে অনুরোধ করেছে। মেমারির তৃণমূল বিধায়ক আবুল হাসেম মণ্ডলও কবুল করেন, ‘‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে যাতে অঘটন না ঘটে, পুলিশ সেই বার্তাই দিয়েছে।’’ তৃণমূল পরিচালিত বর্ধমান জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ গোলাম জার্জিসও মেনে নেন, “পুলিশ গোষ্ঠী-সংঘর্ষ ঠেকাতে দলের নেতাদের নিয়ে থানায় শান্তি বৈঠক করছে।”

সে ক্ষেত্রে বৈঠকে তাঁদেরও ডাকা হচ্ছে না কেন, সেই প্রশ্ন তুলছেন বিরোধী নেতারা। জেলার কংগ্রেস নেতা তথা এআইসিসি সদস্য সেলিম মোল্লার প্রশ্ন, ‘‘আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হলে শুধু তৃণমূলকে নিয়ে বৈঠক করাই যথেষ্ট?’’ জেলার এক পুলিশকর্তার জবাব, “যাঁদের উপরে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নির্ভর করছে, শুধু তাঁদেরই ডাকা হচ্ছে।”

অমলবাবুর কটাক্ষ, ‘‘গুন্ডা কারা তা তো সবাই জানে! শাসকদলের দোসর পুলিশের চেয়ে ভাল তা আর কে-ই বা জানে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE