Advertisement
১৬ মে ২০২৪
Chandannagar

Chandannagar: বিদেশি বণিক শ্রেণি ক্ষুদ্র ইউরোপ বানিয়েছিল ভাগীরথীর তীরে, চন্দননগরে

১৮০২ সালে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের ভেতর যুদ্ধ শুরু হলে চন্দননগর আবার দখল করে নেয় ব্রিটিশরা ১৮১৬ পর্যন্ত  চন্দননগর  ব্রিটিশ অধিকারে থাকে।

পুরনো দিনের চন্দননগর।

পুরনো দিনের চন্দননগর। ছবি: সংগৃহীত।

 বিশ্বনাথ  বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:১২
Share: Save:

চন্দননগর। বাংলার বুকে ভাগীরথী নদীর তীরে হুগলি জেলায় অর্ধচন্দ্রাকারে ভেসে থাকা এই ভূখণ্ডটির কথা ভাবলেই যেন ধূসর অতীতের বুক থেকে ভেসে আসে অশ্বক্ষুরের শব্দ। কামান গর্জন। বাণিজ্য নৌকার দাঁড়ের আওয়াজ। ফরাসি জাতীয় সঙ্গীতের সুর। আর নদীস্রোতের কালজয়ী শব্দমালা। এর আগে চন্দননগরের প্রাকঔপনিবেশিক ইতিহাস ছিল। সেখানে লৌকিক জীবনের সমারোহ ছিল... লৌকিক সংস্কৃতির ইতিহাস ছিল।
তার পর ইউরোপীয় বাণিজ্যের প্রয়োজনে সপ্তদশ শতক থেকে ধীরে ধীরে এসে যাওয়া বিদেশি বণিক শ্রেণির ইতিহাস তৈরি হয়েছিল। যারা পরবর্তী কালে হুগলি জেলায় ভাগীরথী নদীর তীরে গড়ে তোলে কুঠি এবং প্রায় বন্দর শহর। ক্ষুদ্র ইউরোপ যেন তৈরি হয়ে যায় ভাগীরথীর তীরে।

চন্দননগরে ঘাঁটি তৈরি করে ফরাসিরা কুঠি স্থাপন করে। পুঁজি বিনিয়োগ করে। বাণিজ্যকেন্দ্র ও দুর্গ স্থাপন করে। ১৬৮৬ সালে হুগলিতে মুঘলবাহিনীকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করেছিল ব্রিটিশ শক্তি।তাদের ভয় পেতে শুরু করেছিল ডাচেরা। ডাচ কর্তৃপক্ষ কিন্তু নবোদিত ফরাসি শক্তির সঙ্গে আঁতাঁত করেছিলেন। কিছু দিনের মধ্যে চন্দননগরে ফরাসি বাণিজ্য দফতর স্থাপিত হয় মুঘল ফরমান পেয়ে। চন্দননগর (ইংরেজি নাম উল্লেখে চন্দরনগর) বন্দরভূমির পশ্চাদভূমিতে ক্রমশ ফরাসিরা শান্তিশৃঙ্খলা প্রবর্তন এবং দুর্গ গড়ে তুললে ঔপনিবেশিক যুগের সূচনা হয়। দুর্গের নাম ছিল ‘ফোর্ট দি অরলাঁ’। মানুষ এসে ফরাসি দুর্গের ছায়ায় আশ্রয় নিতে থাকে। শহর চন্দননগরের ইতিহাস শুরু হয়।

প্রথম পর্যায়ে উত্তর চন্দননগর, বিশেষত বোড়ো কিষেনপুরকে ধরে... দ্বিতীয় পর্যায়ে গোঁদলপাড়া দুপ্লেক্সপটি অথবা বলা যায় দক্ষিণ চন্দননগর ধরে। এর ভিতর মধ্য চন্দননগরে তৈরি হয়েছিল ফরাসিদের জন্য সাদা মানুষের এলাকা বা ‘ভিল্ দ্য ব্লাশ’।

১৮৭০-৭১ সালের সার্ভে ম্যাপে দেখা গেল, শহর অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। ১৭৫৭ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চন্দননগর দখল করে নেয়। ১৭৬৩ পর্যন্ত ব্রিটিশ অধিকারে ছিল চন্দননগর। এই সময় ব্রিটিশ ধ্বংসলীলার জেরে চন্দননগর শ্রীহীন হয়ে পড়ে। অরলিয়াঁ দুর্গ এবং বড় বড় বাডিগুলি সব ব্রিটিশ শক্তি ভেঙে ফেলে। ফরাসিদের ইজারাদার বা কূর্তিয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়িও ভেঙে ফেলা হয়।

১৭৬৩ সালের মাঝামাঝি ফরাসিরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে চন্দননগর ফেরত পায়।

উনিশ শতকের প্রথমেও বিপদের মুখে পড়ে চন্দননগর। ১৮০২ সালে ফ্রান্স-ইংল্যান্ডের যুদ্ধ শুরু হলে চন্দননগর আবার দখল করে নেয় ব্রিটিশরা। ১৮১৬ পর্যন্ত চন্দননগর ব্রিটিশ অধিকারে থাকে। ১৮১৬ সালের পর থেকে ফরাসি শাসনকাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে। চন্দননগর থেকে পুদুচেরি কাউন্সিলে সদস্য পাঠানো হত দু’টি তালিকা ধরে।

প্রথম তালিকা ছিল কেবলমাত্র ফরাসি বা এ দেশের বসবাসকারী ফরাসি বংশধরদের জন্য। তাঁদের ক্ষমতা ও গুরুত্ব দু’ই বেশি ছিল। এদের বলা হত রেনেসাঁ।

দ্বিতীয় তালিকায় ছিল এ দেশের মানুষ অর্থাৎ জন্মসূত্রে যাঁদের ফরাসিদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।

তিনটি কাউন্সিল ছিল
১. মিউনিসিপ্যাল
২. লোকাল
৩. জেনারেল কাউন্সিল

প্রথমটিতে চার জনকে নির্বাচিত করা হত। যাঁরা স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটি চালানোয় অংশ নিত।

চন্দননগরে পুরসভা তৈরি হয় ১৮৮০ সালে। তখন চন্দননগরে ফরাসি আধিপত্য আবার ফিরেছে। শহরে তৈরি হয়েছে অনেক নতুন বাড়ি। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উত্থান ঘটেছে। উনিশ শতকীয় নাগরিক স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে। এ সময়েই পুরশাসনের পর্যায় আসে।

ভাগীরথী নদীর তীরে হুগলি জেলায় অর্ধচন্দ্রাকারে ভেসে থাকা এই ভূখণ্ডটিই চন্দননগর।

ভাগীরথী নদীর তীরে হুগলি জেলায় অর্ধচন্দ্রাকারে ভেসে থাকা এই ভূখণ্ডটিই চন্দননগর। ছবি: সংগৃহীত।

ইতিমধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। সেই যে ১৬৮৮ সালে ফরাসি কোম্পানি ৯৪২ হেক্টর জমি কিনল আর মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে ১৬৯৩ সালে অবাধ বাণিজ্যের অধিকার পেল, তার পর অনেক দিন কেটে গিয়েছিল। ১৭৬৯ সালে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লোপ পায় এবং চন্দননগর সরাসরি ফরাসি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। অনেক পরে ১৯৫০ সালের ২রা মে চন্দননগর স্বাধীনতা পায় ফরাসিদের কাছ থেকে। পরে ভারতে যোগ দেয়।

আমরা ফিরে যাই পুরশাসনের কথায়। জনগণকে শাসনের স্বাদ দেওয়া ও শহরটির উপর পুর নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য পুরশাসনের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথম মেয়র ছিলেন মঁসিয়ে সি.দ্যুমেন। ১৮ ৮৩ সালে প্রথম বাঙালি মেয়র হন দীননাথ দাশ। রাস্তায় গ্যাসবাতি বসে প্রধানত সাদা মানুষদের এলাকায়। সুরকি ও ইট দিয়ে রাস্তা বাঁধানো হতে থাকে। ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী, ফুটপাত তৈরি, বৃক্ষরোপন প্রভৃতি নানা কাজ চলে। ১৮৮৩ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে কখনও এ দেশি, কখনও ফরাসি মানুষ মেয়র হন। ১৯২২ সাল থেকে দেশীয় মানুষেরাই পুরপ্রধান হতে থাকেন। তাঁদের মধ্যে চারুচন্দ্র রায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।

এই পুরনিগমকে ঘিরে চন্দননগরে জনসচেতনতার অঙ্কুর মাথা তোলে। প্রজা সমিতি, দেশহিত সভা, জনসম্মিলনী, যুব সমিতি প্রভৃতি নানা মতবাদী দলের প্রচার ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ চন্দননগরে নাগরিক স্বাধীনতাকে বিশেষ মর্যাদা দেয়। বামপন্থী, গণতন্ত্রী, জাতীয়তাবাদী, দক্ষিণপন্থী প্রভৃতি নানা মতবাদ বিকশিত হয়। একদা ফরাসি অধিকৃত এই ভূখণ্ড বিপ্লবীদের আশ্রয় দিত। বিপ্লবতীর্থ হয়ে উঠেছিল চন্দননগর। পরে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেও বিপ্লবীদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

আজকাল সমুদ্রে জেগে আছে বিপ্লবী ও শহিদদের স্মৃতি, সাধারণ মানুষদের কথা, জগদ্ধাত্রী পুজোর মতো উৎসবের কথা, মানুষের মহাসমন্বয়ের ইতিহাস ঘিরে রয়ে গিয়েছে চন্দননগর। তার অতীত গৌরব নিয়ে। গঙ্গার মতো ইতিহাসও চন্দননগরের স্মৃতিকে বক্ষে স্থান দিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chandannagar Municipal Elections
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE