বেলুড়ের বাসিন্দা গুড্ডি সিংহের তিন সন্তান। বয়স ১৫, ৯ এবং ৭ বছর। তিন জনকেই সাবেক বালি পুরসভার তরফে জন্মের শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল। আর তাতে জন্মস্থান হিসেবে পুরসভা পরিচালিত কেদারনাথ আরোগ্যভবন হাসপাতালের নামও লেখা রয়েছে।
এই পর্যন্ত সব ঠিক মনে হলেও গোল বেঁধেছে অন্যত্র। দেখা যাচ্ছে বালির ওই কেদারনাথ আরোগ্যভবন হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে গুড্ডিদেবীর তিন সন্তানের জন্ম সম্পর্কিত কোনও তথ্যই নথিভুক্ত নেই! তা হলে প্রশ্ন হল, ওই তিন শিশুর জন্ম কোথায় হয়েছে? আর তাদের জন্মের শংসাপত্রে ওই হাসপাতালের নামই বা এল কী করে?
তবে এই ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছেন না পুর কর্তারা। তাঁদের মতে, ঠিক করে তদন্ত হলে এমন অসংখ্য শংসাপত্র বেরিয়ে আসতে পারে। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগও উঠতে শুরু করেছে। কেদারনাথ আরোগ্যভবন হাসপাতাল বালির যে ওয়ার্ডে (৫৩ নম্বর) অবস্থিত সেখানকার তৃণমূল কাউন্সিলর বলরাম ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ঘুষ কাণ্ডের পরে আবার বার্থ সার্টিফিকেট কেলেঙ্কারি! বাম আমলের আরও কত দুর্নীতি যে বেরোবে তা কেউ জানে না।’’ বছর খানেক আগেই সাবেক বালি পুরসভার এক ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি থেকে ২১ কোটি টাকা উদ্ধারের পরে চরম বিপাকে পড়তে হয়েছিল পুর কর্তাদের। ফের এক মহিলার তিন সন্তানের জন্মের শংসাপত্রকে ঘিরে এমন রহস্য তৈরি হওয়ায় চিন্তায় পড়েছেন পুরকর্তারা।
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই নড়েচড়ে বসেছে তৃণমূল পরিচালিত হাওড়া পুরসভা। মেয়র রথীন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বাম পরিচালিত বালি পুরসভার সময়কালে এই গরমিল দেখা দিয়েছিল। হাওড়ার সংযুক্ত হওয়ার পরে এখন তা সামনে এসেছে। কি ভাবে কি ঘটেছে তা জানতে পুর কমিশনারকে একটি তদন্ত কমিটি গড়তে বলেছি।’’ পুর কমিশনার নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কী ভাবে এমন গরমিল হল তা স্পষ্ট হচ্ছে না। ডেপুটি কমিশনার, চিফ অডিটর ও এক চিকিৎসককে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। আগামী সাত দিনের মধ্যে তাঁরা রিপোর্ট জমা দেবেন।’’
যদিও সাবেক বালি পুরসভার চেয়ারম্যান সিপিএমের অরুণাভ লাহিড়ীর কথায়, ‘‘জন্ম-মৃত্যুর শংসাপত্রে সই করেন স্বাস্থ্য দফতরের অফিসার। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান কিংবা অন্য কারও কাছেই কোনও ফাইল আসেই না। তাই জানারও কথা নয়।’’ পাশাপাশি তাঁরও দাবি, ‘‘যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা কখনই হওয়ার কথা নয়। তদন্ত হোক, তা হলেই প্রকৃত দোষী সামনে আসবে।’’
ঘটনাটি প্রকাশ্যে এল কী ভাবে?
বেলুড় হরিচরণ ব্যানার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা আছেকুমান সিংহের স্ত্রী গুড্ডিদেবীর দাবি, গত ৩১ মার্চ তিনি ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন শংসাপত্র ফোটোকপি করাতে গিয়ে তিনটি ডিসচার্জ সার্টিফিকেটই হারিয়ে ফেলেন। এর পরে বেলুড় থানায় অভিযোগ দায়ের করে হাওড়া পুরসভার বালি শাখা অফিসে সেগুলির প্রতিলিপি পাওয়ার আবেদন করেন। তখনই হাসপাতালের নথি পরীক্ষা করতে গিয়ে এই বড়সড় গরমিল চোখে পড়ে পুরকর্মীদের।
গরমিল কোথায়?
পুরসভা সূত্রের খবর, জন্মের তিনটি আলাদা শংসাপত্র অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ৫ অক্টোবর ২০০১ সালে কেদারনাথ আরোগ্যভবনে গুড্ডিদেবী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এর পরে ১৫ মার্চ ২০০৭-এ ওই হাসপাতালেই তাঁর আর একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়েছে। আবার ৯ নভেম্বর ২০০৯ সালে ওই কেদারনাথ আরোগ্য ভবনেই গুড্ডিদেবীর এক পুত্রসন্তান জন্মেছে। নিয়মানুযায়ী হাসপাতালের রেজিস্ট্রার খাতায় ওই মহিলার ভর্তি হওয়া, বাচ্চা জন্মানো এবং হাসপাতাল থেকে ছুটি-সমস্ত তথ্যই নথিভুক্ত থাকার কথা। কিন্তু ওই তিনটি বছরের হাসপাতালের নথিতে ওই মহিলার ভর্তি হওয়া কিংবা বাচ্চা জন্মানো কিংবা ছুটি কোনও কিছুরই উল্লেখ নেই।
এক পুরকর্তা জানান, নিয়মানুযায়ী কোনও শিশুর জন্মের পরে হাসপাতাল থেকে নথি পুরসভায় পাঠানো হয়। এর পরে বাচ্চার বাড়ির লোক হাসপাতালের দেওয়া ডিসচার্জ সার্টিফিকেট নিয়ে পুরসভায় গেলে তবেই তাঁকে জন্মের শংসাপত্র দেওয়া হয়। ওই কর্তা বলেন, ‘‘গুড্ডিদেবীর ক্ষেত্রে তিন বারই কোনও তথ্য হাসপাতালের খাতায় না থাকা সত্ত্বেও কী করে তিনি পুরসভা থেকে বার্থ সার্টিফিকেট পেলেন তা স্পষ্ট হচ্ছে না।’’
তদন্তে নেমে পুরকর্তাদের সামনেও উঠে এসেছে কয়েকটি প্রশ্ন। এক, যদি গুড্ডিদেবী সাবেক বালি পুরসভা পরিচালিত কেদারনাথ আরোগ্যভবনে ওই তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন তবে সেই তথ্য নথিভুক্ত নেই কেন? দুই, ধরে নেওয়া যাক হাসপাতালের নথিই ঠিক। তা হলে পুরসভা ওই হাসপাতালেই বাচ্চাগুলির জন্ম হয়েছিল বলে কী ভাবে শংসাপত্র দিল? তিন, গুড্ডিদেবীর ক্ষেত্রেই তিনবার একই ভুল হল কী করে?
তদন্তে নেমে প্রাথমিক ভাবে পুরকর্তারা মনে করছেন, এই ঘটনার পিছনে বড় কোনও চক্র কাজ করেছে। হতে পারে ওই মহিলা কোনও দিনই কেদারনাথ আরোগ্যভবন হাসপাতালে ভর্তিই হননি। সেখানে সন্তানের জন্মও দেননি। অন্যত্র কোথাও জন্মেছে তাঁর সন্তান। কিন্তু প্রতিবারেই কোনও
না কোনও ভাবে সাবেক বালি পুরসভার শংসাপত্র জোগাড় করেছেন। গুড্ডিদেবীকে তাঁর তিন সন্তান কোথায় জন্মেছে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। তাঁর কথায়, ‘‘কাগজে লেখা আছে বাচ্চারা কোথায় হয়েছে। আর কিছু মনে নেই।’’
পুর কমিশনার নীলাঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘কমিটি সমস্ত দিকই খতিয়ে দেখছে। তদন্তে যাঁরই দোষ প্রমাণিত হবে, তাঁর বিরুদ্ধেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ কমিশনারের কাছেও নির্দিষ্ট নাম দিয়ে এফআইআর দায়ের করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy