হাসপাতালে অসুস্থ নন্দকিশোর দাস। ছবি: তাপস ঘোষ
পড়ন্ত বিকেলে ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটি ইএসআই হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে হতাশা চেপে রাখতে পারছিলেন না নন্দকিশোর দাসের বড় মেয়ে পুনম।
মাস চারেক ধরে বাবাকে নিয়ে কখনও গৌরহাটি, কখনও শিয়ালদহ ইএসআই, কখনও বালিগঞ্জের বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখনও রোগ নির্ণয় হয়নি। শুক্রবারেই তাঁকে গৌরহাটি হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা চলছিল। কিন্তু শেষমেশ তা হল না।
বছর বিয়াল্লিশের নন্দকিশোর চন্দননগরের গোন্দলপাড়া চটকলের শ্রমিক। সাত মাস মিলটি বন্ধ। তাঁর স্বাস্থ্যবিমার টাকাও জমা পড়েনি। ফলে, ইএসআই হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবার মেয়াদ ফুরিয়েছে। বুধবার ফের একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন জুটমিল কর্তৃপক্ষ। পার্সোনেল ম্যানেজারের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, কাঁচা পাট না-থাকায় মিল খোলা যাচ্ছে না। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে পরিস্থিতির কথা জনিয়েও কোনও লাভ হয়নি। ঋণও মিলছে না। বিজ্ঞপ্তির খবরে শ্রমিকদের মধ্যে উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
অথৈ জলে পড়েছে নন্দকিশোরের পরিবার। গৌরহাটি হাসপাতালের মেল মেডিক্যাল ওয়ার্ডে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরচ্ছেন ওই শ্রমিক। পুনম হিন্দি অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। আরও চার বোন আছে। সবাই স্কুলে পড়ে। পুনম বলেন, ‘‘বাবাই একমাত্র রোজগেরে। কী ভাবে বাবাকে সুস্থ করে তুলব, ভেবে পাচ্ছি না।’’ গৌরহাটি হাসপাতালের সুপার অভ্রজিৎ মুখোপাধ্যায় জানান, নন্দকিশোরবাবুর যে ধরনের চিকিৎসা দরকার, তা এখানে সম্ভব নয়। অন্য হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা করা হবে। এ দিন তাঁর পেট থেকে জল বের করা হয়েছে।
আর্থিক অসঙ্গতি এবং কাঁচা পাটের অভাবের কারণ দেখিয়ে গত মে মাসে ওই চটকলে ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর বিজ্ঞপ্তি ঝোলান কর্তৃপক্ষ। হাজার পাঁচেক শ্রমিক বিপাকে পড়েন। নন্দকিশোরের মতো অনেক শ্রমিকের পরিবারই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে রীতিমতো নাকানি-চোবানি খাচ্ছেন। শুক্রবার দু’দিনের শ্রমিক মেলা শুরু হয়েছে শহরের নাড়ুয়ায়। এ দিন গোন্দলপাড়ার কিছু শ্রমিক দল বেঁধে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ শহরের তেমাথায় তাঁদের আটকে দেয়। পুলিশ সূত্রের খবর, শ্রমিকেরা মেলায় বিক্ষোভ দেখাতে পারেন বলেই তাঁদের আটকে দেওয়া হয়।
পনেরো বছর ধরে এই মিলের তাঁত বিভাগে কাজ করছিলেন মহম্মদ আলাউদ্দিন। বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে প্রতিবন্ধী। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও রকমে পেট চালাচ্ছি। ছেলের চিকিৎসা করার উপায়টুকু নেই।’’ আলাউদ্দিন, শ্যামকুমার চৌধুরী, মনোজ চৌধুরী, বিনোদ প্রসাদরা সকাল হলেই বিভিন্ন চটকলে ছুটে বেড়াচ্ছেন বদলি শ্রমিক হিসেবে কাজ পাওয়ার আশায়। কখনও উত্তর ২৪ পরগনা, কখনও ভদ্রেশ্বর, কখনওবা হাওড়ায়। মাসের অর্ধেক দিনও কাজ মিলছে না।
রাজেশ জয়সোয়ারা নামে এক শ্রমিক-নেতা বলেন, ‘‘অনৈতিক ভাবে মিল বন্ধ করা হয়েছে। প্রশাসন কিছুই করছে না। শ্রমিকদের না-খেতে পেয়ে মরার অবস্থা।’’ মনোজবাবু বলেন, ‘‘এক ছেলে মাধ্যমিক, আর এক জন উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। ওদের টিউশনের টাকা বাকি পড়েছে।’’ আর এক শ্রমিক নেতা, চন্দননগরের প্রাক্তন বিধায়ক রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘শ্রমিকদের নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি। মিল বন্ধের কোপ বিনা দোষে শ্রমিকদের উপরে কেন পড়বে?’’
ওই চটকলের শ্রমিকদের পাওনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কল্যাণ সমিতি। অবিলম্বে মিল খোলা এবং বন্ধ থাকাকালীন অবস্থায় শ্রমিকদের বেতন মিটিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা। মালিকের ‘বেআইনি’ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে শ্রম দফতরকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানিয়েছে। চটকল কর্তৃপক্ষের দেওয়া বিজ্ঞপ্তি এবং নন্দকিশোরবাবুর চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন কৃষি বিপণন মন্ত্রী তপন দাশগুপ্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy