কচুরিপানায় বুজে গিয়েছে নিকাশি নালা।
কলকাতায় পা রাখার আগে জব চার্নক এসেছিলেন উলুবেড়িয়াতে।
১৬৮৭ সালের ১৭ জুন জাহাজ নিয়ে হুগলি নদীর তীরে উলুবেড়িয়ায় হাজির হলেন। এখানে একটি বন্দর ও জাহাজ মেরামতির কারখানা তৈরির জন্য লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। এই সময়ে বেশ কিছুদিন উলুবেড়িয়ার জগদীশপুরে জব চার্নক বসবাসও করেছিলেন। কিন্তু খারিজ হয়ে যায় এখানে বন্দর তৈরির প্রস্তাব। অগত্যা সদলবলে তিনি কলকাতায় পাড়ি দেন। গঙ্গার পূর্ব তীরের ভাগ্যের চাকা ঘোরার সেই শুরু। সেদিন এ দিকে বন্দর-কারখানা তৈরির মুঘল ফরমান মিললে হয়তো উলুবেড়িয়াই হয়ে উঠত মহানগরী।
পুরনো উলুবেড়িয়াকে খঁুজে পেতে হলে আজও আসতে হবে হুগলির নদীর পাড়ে। নৌ-যোগাযোগের সুবিধার কথা মাথায় রেখেই ৩৫০ বছরের প্রাচীন এই শহরকে যে গড়ে তোলা হয়েছিল তার নজির মিলবে প্রতি পদে। মহকুমা পুলিশ, মহকুমাশাসকের দফতর, উলুবেড়িয়া থানা, মহকুমা আদালত, জেলখানা তত্কালীন মহকুমা হাসপাতাল এমনকী যৌনপল্লিও গড়ে উঠেছিল হুগলি নদীর ধার ঘেঁষে। কালীবাড়ি থেকে রবীন্দ্রভবন, সবই নদী ঘেঁষে।
পূূর্ব দিকে হুগলির পাড় থেকে পশ্চিমে গঙ্গারামপুর এবং উত্তরে নিমদিঘি থেকে দক্ষিণে জগদীশপুর--এই হল উলুবেড়িয়ার বিস্তার। পুরসভায় মোট ওয়ার্ড-এর সংখ্যা ২৯টি, তবে শহর এলাকা বলতে মূলত ১ থেকে ১৩ নম্বর ওয়ার্ড। হুগলি নদীর পাড় থেকে শুরু এই শহরের গলি, তস্য গলির মাধ্যমে উলুবেড়িয়ার অন্দরে ঢুকে পড়েছে শিসবেড়িয়া, গরুহাটা, নোনা, নিমদিঘি, বানিতবলা, ডোমপাড়া পারিজাত, বাজারপাড়া, উত্তর জগদীশপুরের মতো মহল্লা। সময়ের দাবি মেনে শীতলপাটি বিছানোর মতো ক্রমশ শহর ছড়িয়েছে পূব থেকে পশ্চিমে ও উত্তর থেকে দক্ষিণে। চওড়া হয়েছে রাস্তা। গড়ে উঠেছে বহুতল, ঝাঁ চকচকে রেস্তোঁরা, শপিং মল।
শহরে নিকাশি নালার উপরেই তৈরি হয়েছে বেআইনি নির্মাণ।
অথচ এক কথায় কি বলা চলে, উলুবেড়িয়া এগিয়ে চলেছে?
এই ভরা বর্ষায় তার উত্তর দিতে গেলে হোঁচট খেতে হয়। উলুবেড়িয়ায় নিকাশি সমস্যা যাতে না হয় তার জন্য নজর দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ আমলেই। ওড়িশা ট্রাঙ্ক (ওটি) রোড বরাবর তৈরি হয়েছিল নিকাশি নালা। হুগলি নদী থেকে সেই নালা বেরিয়ে গঙ্গারামপুর থেকে বেরিয়ে সেটি আবার ফিরে গিয়েছে হুগলি নদীতেই।
আজ অবিন্যস্তভাবে গড়ে উঠেছে বহুতলগুলি। ইংরেজ আমলের নিকাশি নালা সংস্কার হওয়া তো দূরের কথা, সেটিকে বুজিয়েই গড়ে উঠেছে বহুতল, নার্সিং হোম, দোকানঘর। শহরের ভিতরে একসময়ে ছিল প্রচুর সুতিখাল। যখন পুরো এলাকা গ্রাম ছিল, তখন এইসব সুতিখালের মাধ্যমে হুগলি নদীর জল এনে চাষাবাদ হত। শহর বেড়ে যাওয়ার পরে এই খালগুলি সংস্কার করে নিকাশি নালায় পরিণত করা যেত। শহরবাসীর অভিযোগ, তা করা হয়নি। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই গলি তো বটেই, ডুবে যায় প্রধান রাস্তাগুলিও। মূল শহরের শিসবেড়িয়া, পারিজাত, বাজারপাড়া, হাটকালিগঞ্জ, ফতেপুর, ময়রাপাড়া এলাকাগুলি বর্ষায় সম্পূর্ণ জলমগ্ন। বহু বাড়ির একতলার মেঝে ডুবে গিয়েছে এ বারেও।
২০১০ সালে পুরসভায় ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। তার আগে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট। কয়েক মাস ক্ষমতায় থাকার পরে পুরসভার ক্ষমতা আবার চলে আসে তৃণমূলের হাতে। নিকাশি নালা সংস্কার কিন্তু অবহেলিত রয়েই গিয়েছে। বামফ্রন্ট আমলে পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন বটকৃষ্ণ দাস। তিনি বলেন, “এখন আমি প্রাক্তন, এ বিষয়ে একটি কথাও বলব না।” কংগ্রেস-শাসিত পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান সাইদুর রহমানের দাবি, “আমি যখন চেয়ারম্যান ছিলাম, নিকাশি খালগুলি সংস্কারের জন্য নিয়মিত রাজ্য সরকারের কাছে দরবার করেছি। তার ফলেই পরবর্তীকালে রাজ্য সরকার চার কোটি টাকা পাঠায়। তার পরে তৃণমূলের হাতে ক্ষমতা আসে। ওই টাকা নিয়ে তারা কী করছে বলতে পারব না। নালা যে সংস্কার হয়নি তা দেখতেই পাচ্ছি।”
তৃণমূল শাসিত বোর্ড-এর মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৬ জুলাই। তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পুরসভার দেখভালের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, সেই উলুবেড়িয়া দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক পুলক রায় স্বীকার করলেন শহরের নিকাশি নালা খুবই বেহাল। তবে এর জন্য বামফ্রন্ট শাসিত পুরসভা বোর্ডকেই দায়ী করলেন তিনি। তাঁর কথায়, “গত ২৭ বছর ধরে উলুবেড়িয়া পুরসভায় ক্ষমতায় থেকেও বামফ্রন্ট নিকাশি নালার সংস্কারের কোনও পরিকল্পনাই নেয়নি। ফলে সমস্যাটি জটিল হয়ে গিয়েছে।” তাঁর দাবি, পুরসভা একটি মাস্টার প্ল্যান পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরে জমা দিয়েছে। তবে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হলেও বেশ সময় লাগবে। প্রয়োজন হবে প্রচুর টাকারও।
বেআইনি নির্মাণের দায়ও পুলকবাবু চাপিয়ে দেন পূর্বতন বামফ্রন্ট শাসিত পুরবোর্ডের ঘাড়ে। তবে তাঁর বক্তব্য, “এই সংস্কৃতি বেশ পুরনো। আমাদের আমলেও যে বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে না তা নয়, জানতে পারলেই আটকাচ্ছি।”
গত তিন-চার দশকে চোখের সামনে শহরটা বদলে গেল,” বললেন অধ্যাপক মাজেদ মোল্লা। উলুবেড়িয়া কলেজের সহ-অধ্যক্ষ মাজেদ মোল্লা উলুবেড়িয়ার ইতিহাস নিয়ে বইও লিখেছেন। তাঁর কথায়, “নিকাশি ব্যবস্থা তখন এতটা বেহাল ছিল না। মেদিনীপুর ক্যানাল, ওটি রোডের ধার বরাবর নিকাশি নালা ছিল। বর্ষায় শহরে এক ফোঁটা জলও জমত না। আজ সেই সব খাল বুজে গিয়েছে, কেউ নজরই দিল না। শহর এখন বাটির মতো, সামান্য বৃষ্টিতেই জল জমে যায়।”
ছবি: সুব্রত জানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy