Advertisement
১৯ মে ২০২৪

প্রতিবন্ধী নাতিটার কী হবে, কেঁদে আকুল ঠাকুমা

বছর তেরোর রাহুলের দু’টো পা-ই বিকল। চলচ্ছক্তিহীন। সকাল থেকে বাবা, মা, দাদার ফোনের জন্য ছটফট করছিল সে। সেই কোন ভোরে মাকে নিয়ে চিকিত্‌সার জন্য কলকাতায় গিয়েছেন বাবা, দাদা। প্রায়ই যান। কিন্তু কোনও বারই কলকাতায় পৌঁছে বাবা-মা রাহুলকে ফোন করতে ভোলেন না। এ বার কেন ওঁরা ফোন করছেন না? কেনই বা মোবাইল ধরছেন না? কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না তার।

দুর্ঘটনার পরে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বুলাদেবীদের গাড়ি।

দুর্ঘটনার পরে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বুলাদেবীদের গাড়ি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গোঘাট ও শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:৫০
Share: Save:

বছর তেরোর রাহুলের দু’টো পা-ই বিকল। চলচ্ছক্তিহীন। সকাল থেকে বাবা, মা, দাদার ফোনের জন্য ছটফট করছিল সে।

সেই কোন ভোরে মাকে নিয়ে চিকিত্‌সার জন্য কলকাতায় গিয়েছেন বাবা, দাদা। প্রায়ই যান। কিন্তু কোনও বারই কলকাতায় পৌঁছে বাবা-মা রাহুলকে ফোন করতে ভোলেন না। এ বার কেন ওঁরা ফোন করছেন না? কেনই বা মোবাইল ধরছেন না? কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না তার।

গোঘাটের কাঁঠালি গ্রামে বাড়িতে বসে অবশ্য বাবা-মায়ের জন্য অপেক্ষাই সার হল গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া রাহুলের। বিকেলে বাবা-মা-দাদার শেষ পরিণতির কথা শুনে কথা হারিয়েছে তার। বাবা-মায়ের অবর্তমানে প্রতিবন্ধী ছেলেটার কি হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আত্নীয়রা। চিন্তায় প্রতিবেশীরাও।

এ দিন সকালে হরিপালে পথ-দুর্ঘটনা ওই পরিবারের তিন জনের প্রাণ কেড়ে নেওয়ায় নায়েক বাড়িতে এখন সদস্য বলতে রাহুল আর তার ৮৪ বছরের ঠাকুমা গীতা নায়েক। বয়সের ভারে কোমর সোজা করে হাঁটতে পারেন না বৃদ্ধা। এই বয়সে ছেলে-বৌমা-বড় নাতির মৃত্যুর খবর শুনে এ দিন মুর্ছা গিয়েছেন বার বার।

মৃত দম্পতি অমিত-বুলা বা তাঁদের ছেলে অর্ঘ্য নায়েকের সঙ্গে প্রতিবেশীদের যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল। দুর্ঘটনার খবর চাউর হতেই গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। বাড়ির সামনে জটলা বাড়তে থাকে। সেখানে শুধু আলোচনা, এ বার কে দেখবে রাহুলকে? গীতাদেবীই বা কি ভাবে সামলে উঠবেন এমন শোক! সেই চিন্তায় শোকের ছায়া দীর্ঘতর হয়েছে গ্রামে। পড়শিদের অনেকের বাড়িতেই রান্না চড়েনি। গ্রামের যুবকরা দল বেঁধে শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে গিয়েছেন ময়না-তদন্তের পরে দেহ গ্রামে নিয়ে আসার জন্য। সেখানেও কারও মুখে কথা সরছিল না যেন! প্রত্যেকের চোখমুখ বলে দিচ্ছিল, ঘটনার আকস্মিকতা মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা।

গ্রামে খবর এসে পৌঁছতেই নায়েক পরিবারে কান্নার রোল।

মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে অমিতবাবুর জ্যাঠতুতো ভাই, স্কুলশিক্ষক সুব্রত নায়েক বলছিলেন, “আমাদের এক চিকিত্‌সক দিদি অমিতদার মোবাইলে ফোন করলে এক পুলিশ অফিসার ফোন ধরেন। তাঁর কাছেই খবর পাই। শুনেই এখানে চলে এসেছি। এমন মর্মান্তিক ঘটনা কল্পনাই করতে পারছি না।” সুব্রতবাবু জানান, একটি সমবায় সমিতির ম্যানেজার অমিতবাবু মিশুকে ছিলেন। তাঁর বড় ছেলে অর্ঘ্য মেধাবী ছাত্র। তিনি আরামবাগ কলেজ থেকে রসায়নে অনার্স নিয়ে পাশ করার পরে কলকাতায় থেকে একটি কলেজে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। মঙ্গলবার বাড়িতে এসেছিলেন। মাকে ডাক্তার দেখিয়ে কলেজে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর।

সকাল থেকে গীতাদেবী এবং রাহুলকে ঘটনার কথা জানাননি প্রতিবেশীরা। দু’জনেই জানালা দিয়ে দেখেছেন, তাঁদের বাড়িকে কেন্দ্র করে জটলা। বৃদ্ধা বাইরে বেরিয়ে জানতে চেয়েছেন, কি হয়েছে! প্রতিবেশীরা পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। দুপুরে গীতাদেবীর চার মেয়ে প্রতিমা কুন্ডু, পূর্ণিমা কুন্ডু, অনিমা দে এবং অসীমা পাল একে একে বাপেরবাড়ি আসেন। কোনও অনুষ্ঠান ছাড়াই এক সঙ্গে তাঁদের দেখে বৃদ্ধা প্রথমে খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েদের চোখমুখ দেখে অশুভ কিছু আঁচ করে থম মেরে যান। রাহুল কখনও পিসিদের কাছে বায়না করেছে, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁরা যেন মোবাইলে টাকা ভরে দেন। কখনও পিসতুতো দাদা নীলমাধবকে ফোন করে অনুযোগ করেছে, বাবা-দাদা ফোন করছেন না। তিনি যেন দেখেন ওঁদের কি হল। নীলমাধব বলেন, “ছেলেটাকে মিথ্যে বলে এড়িয়ে গিয়েছি। খবরটা দিতে পারিনি।” শেষ পর্যন্ত বিকেলে সব জানতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে রাহুল। গীতাদেবীকে খবরটা দেন প্রতিমাদেবীরাই। রাহুলকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, “ওঁরা কেউ বেঁচে নেই। আমাদের কাছেই থাকবি তুই।” অনিমাদেবী বলেন, “বেশ কয়েক বছর আগে ছোট ভাই বিদ্যুত্‌স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। তার পরে এই ঘটনা আমরা বিশ্বাসই করতে পারছি না। ছোট ভাইপোটা আবার হাঁটতে চলতেই পারে না! কী যে হবে!”

প্রতিবেশী দুলাল সরকার বলেন, “গীতাদেবীর অনেক বয়স। কোমরের সমস্যার জন্য কুঁজো হয়ে হাঁটেন। এখন রাহুলকে কে দেখবে!”

ছবি তুলেছেন দীপঙ্কর দে ও মোহন দাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

southbengal car accident haripal goghat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE