হাটে চলছে বেচাকেনা।—নিজস্ব চিত্র।
ভোরের আলো ফুটলেই গোটা চত্বর কলকলিয়ে উঠতে শুরু করে। মাটির ভাড়ে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিয়ে আলু, পটল, কুমড়োর দর হাঁকা শুরু করে দেন ব্যাপারী। সকাল গড়িয়ে দুপুর থেকে বিকেল পেরিয়ে সন্ধে, রাত পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। রাত ১১টার পরে ঘণ্টা চারেকের বিরাম বাদ দিলে এই বাজারের ঘুম নেই।
পোশাকি নাম শেওড়াফুলি হাট। হুগলি জেলায় পূর্ব ভারতের কাঁচা আনাজের অন্যতম প্রধান বাজারে আপনি স্বাগত।
এলাকার প্রবীণ মানুষজনের বক্তব্য, আগে বাজারটি শেওড়াফুলিতে ছিল না। তখন বৈদ্যবাটির নিমাইতীর্থ ঘাটের কাছে বাজার বসত। বড় বড় নৌকা করে জলপথে পণ্য আসত। পরবর্তী কালে শেওড়াফুলিতে বাজারটি স্থানান্তরিত হয় যাতায়াতের সুবিধার জন্য। সে-ও অন্তত দেড়শো বছর আগের কথা। তারকেশ্বর রেল লাইন লাইন স্থাপন হওয়ায় বাজারের গুরুত্ব বাড়ে। কয়েক হাজার মানুষের রুজিরুটির সংস্থান করে এই বাজার।
শেওড়াফুলি জংশন স্টেশনের কোল থেকেই বাজার শুরু। এক পাশে গঙ্গার দু’পয়সার জেটিঘাট। ঘাটের উল্টোদিকে উত্তর ২৪ পরগনা। হাট থেকে জিটি রোডের দূরত্ব মিনিটখানেক। খানিক দূরেই দিল্লি রোড এবং দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। এ হেন জায়গায় পাইকারি বাজার জমে উঠতে সমস্যা হয়নি। রাত দিন ভ্যানরিকশা থেকে শুরু করে ঠেলা, ট্রাকে কখনও বা নৌকোয় অথবা ট্রেনে সব্জি আনা-নেওয়া চলছে। শুধু কি সব্জি! বরং মুদিখানা থেকে মাছ-মাংস, ফুল-ফল থেকে হার্ডওয়্যারের দোকানসবই আছে দেড় কিলোমিটার চৌহদ্দির এই বাজারে। দোকানের সংখ্যা কয়েকশো। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা শ’চারেক চাষি বা ছোট ব্যবসায়ীর ডালা।
শোনা যায়, এই বাজারের কুমড়োর বেশ কদর ছিল। এই কুমড়োর সিংহভাগ জলপথে হালিশহর থেকে আসত। এক একটির ওজন আধমণের বেশি। প্রবাদ আছে, সাহেবদের ভোজের মেনুর অন্যতম প্রধান আইটেম ছিল এই হাটের কুমড়ো। বৈদ্যবাটির কুমড়ো শুনলে সাহেবরা লোভ সংবরণ করতে পারতেন না। বৈদ্যবাটির পুরপ্রধান অজয়প্রতাপ সিংহ বলেন, “এই হাট পুরসভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শেওড়াফুলি-বৈদ্যবাটির ইতিহাস এই বাজার ছাড়া ভাবা যায় না।” প্রথম দিকে বাঙালি বর্ধিষ্ণু পরিবারের লোকজনই এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী পদ্মপলাশলোচন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের অনেকেই এই হাটে ব্যবসা করতেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, হুগলি ছাড়াও উত্তর ২৪ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া-সহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা এই হাট থেকে মালপত্র কেনাকাটা করেন। এক সময় শুধু শনি-মঙ্গলবারে হাট বসত। পরে অবশ্য চাহিদার কথা মাথায় রেখে সাতদিনই বাজার শুরু হয়। শেওড়াফুলি কাঁচা সব্জি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মুরারিমোহন কুণ্ডু। প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে ব্যবসা করছেন এই হাটে। তাঁর কথায়, “রাজ্যের প্রথম সারির বাজারগুলির মধ্যে শেওড়াফুলি হাট অন্যতম। বাজারের এক এক জায়গায় এক এক রকম জিনিস মেলে। সেই অনুযায়ী আলুহাটা, পিঁয়াজহাটা, মেছোহাটা, কুমড়োহাটা, কলাহাটা প্রভৃতি নামকরণ হয়েছে। তবে, কলাহাটা বর্তমানে অস্তিত্ব হারিয়েছে। শেওড়াফুলির প্রবীণ বাসিন্দা বিকাশেন্দু দে সরকার বলেন, “আগে তারকেশ্বরের দিক থেকে গরুর গাড়িতে কলারকাঁদি আসত। হাট থেকে মাইলখানেক ধরে গরুর গাড়ির লাইন পড়ে যেত। এখন অবশ্য সিঙ্গুরের দেশাপাড়া, ছিনামোড়, পুরুষোত্তমপুরে কলার ব্যবসা উঠে গিয়েছে। এক সময় শিবরাত্রিতে উৎসব হত। যাত্রা হত, পুতুলনাচ হত।
বয়সে প্রাচীন এই ঘিঞ্জি বাজারে সমস্যাও কম নয়। গলি-ঘুপচিতে অনেকে ডালা পেতে বসে পড়েন মাথার উপরে প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে। কোনও কারণে বাজারে আগুন লাগলে অপরিসর রাস্তা দিয়ে দমকলের ঢোকা কষ্টসাধ্য। আগে রাজ্যের কৃষি বিপণন দফতরের অধীন শেওড়াফুলি রেগুলেটিং মার্কেট কমিটি বাজার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করত। এখন তা করে বৈদ্যবাটি পুরসভা। জল-আলোর ব্যবস্থা দেখভালও তারাই করছে। ব্যবসায়ীরা জানান, এক সময় ট্রেনে পার্সেলে বিহার, অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ-সহ অন্যান্য রাজ্য থেকে আনাজ আসত। বেশ কয়েক বছর হল রেল তা বন্ধ করে দিয়েছে। রেলের ওই সিদ্ধান্তে ব্যবসা মার খাচ্ছে। ফের ওই ব্যবস্থা চালু হলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। বাজারের গুরুত্বও আরও বেড়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy