Advertisement
১১ নভেম্বর ২০২৪

শ্রীরামপুরের চটের ব্যাগ, ট্রে-র কদর বাড়ছে ফ্রান্স, আজের্ন্টিনায়

চটই তাঁর হাতিয়ার। চটের জিনিস ছেড়ে গোটা রাজ্য যখন প্লাস্টিকের পিছনে ছুটছে, তখন উল্টো পথে হাঁটছেন শ্রীরামপুরের দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কারখানায় তৈরি চটজাত হরেক জিনিস আজ পাড়ি দিচ্ছে বিদেশের বাজারে।

পুরস্কার নিয়ে দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।

পুরস্কার নিয়ে দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।

প্রকাশ পাল
শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৪ ০১:৫৫
Share: Save:

চটই তাঁর হাতিয়ার। চটের জিনিস ছেড়ে গোটা রাজ্য যখন প্লাস্টিকের পিছনে ছুটছে, তখন উল্টো পথে হাঁটছেন শ্রীরামপুরের দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কারখানায় তৈরি চটজাত হরেক জিনিস আজ পাড়ি দিচ্ছে বিদেশের বাজারে। চটের ব্যাগ থেকে ট্রে কী নেই সেই তালিকায়। দেবব্রত বলেন, “দেশে চটশিল্প ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। আমি কিন্তু এর ঐতিহ্য টিঁকিয়ে রাখতে যথাসাধ্য করব। দূষণের হাত থেকে পরিবেশ বাঁচবে।”

মাঝবয়সী দেবব্রতবাবুর বাড়ি শ্রীরামপুরের তারাপুকুরে। এলাকায় পরিচিত শিবু নামে। বাণিজ্যে স্নাতক শিবুবাবু চটশিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় দু’দশক ধরে। প্রথমে কলকাতার একটি সংস্থায় মার্কেটিংয়ের কাজে হাতেখড়ি। সেখানে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন। বছর ছ’য়েক আগে নিজেই ব্যবসা শুরু করেন নিজের শহরে। বাড়ির অদূরে পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে শুরু হয় উত্‌পাদনের কাজ। সেখানেই দিন রাত তৈরি হচ্ছে চটের নানা জিনিস। দেবব্রতবাবু বলেন, “চটের ঝুড়ি, ট্রে, দরজা ভেজানোর পরে ‘ডোর স্টপার’, বিভিন্ন ধরনের কিট-ব্যাগ, মহিলাদের ফ্যান্সি ব্যাগ-সহ নানা জিনিস তৈরি হয়।” তাঁর দাবি, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে ২৫ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে তাঁর কারখানার জন্য। জাপান, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা, ইজরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্তিনা-সহ বিভিন্ন দেশে তাঁর কারখানায় তৈরি সামগ্রী পৌঁছে যায়।

দেবব্রতবাবু জানান, প্রথমে জুটমিল বা বাজার থেকে চটের কাপড় কেনেন তিনি। সেই কাপড় কেটে, নকশা করে, সেলাই করার পরে বিদেশে রফতানি করা হয়। দেবব্রতবাবুর কথায়, “বিদেশের বাজারে চটজাত দ্রব্যের চাহিদা প্রচুর। দেশ-বিদেশে বহু জায়গায় সব সম্ভার নিয়ে গেছি। বহু মানুষ এ নিয়ে জানতে চান। চট রাজ্যের গর্ব। গুণগত ভাবেও উচ্চমানের। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দিনের পর দিন ধরে এই শিল্প ধুঁকছে। অনেক সময় অর্ডার নিয়েও চিন্তায় থাকতে হয়। কেন না, সব সময়ে চাহিদা মতো চটের জোগান থাকে না। কখনও হয়তো চড়া দামে বাজার থেকে চট কিনতে হয়। মিলের মেশিনগুলো মান্ধাতা আমলের হওয়ায় সমস্যা বাড়ে।”

চটশিল্পের সঙ্গে জড়িত লোকজন মনে করেন, প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের জন্যই এই শিল্পের আজ দূরবস্থা। সে কারণে বিদেশের বাজারে সমাদৃত হলেও এই রাজ্যেই চটশিল্পের দুয়োরানির অবস্থা। আগে কাপড়ের দোকান থেকে চটের ব্যাগ দেওয়া হত খদ্দেরদের। এখন সেই পাট নেই বললেই চলে। চটের বস্তার দাম বেশি হওয়ায়, গম, চিনি-সহ নানা খাদ্যদ্রব্য পর্যন্ত প্লাস্টিকের বস্তায় আসে।

দেবব্রতবাবু বলেন, “চটের মতো পরিবেশবান্ধব আর কিছু নেই। তা সত্ত্বেও পরিবেশের তোয়াক্কা না করে মানুষ ক্যারিব্যাগ-সহ প্লাস্টিকের নানা জিনিসকেই আপন করে নিচ্ছে। একটু সচেতনতা তৈরি হলে কিন্তু এই সমস্যা থাকবে না। উল্টে অন্যতম প্রধান অর্থকরী শিল্প হিসেবে চট ফের নিজের হারানো জায়গা খুঁজে নেবে। চটের তৈরি জিনিস দেখতেও সুন্দর হয়। টেঁকসইও হয়।”

সম্প্রতি দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারে উদ্যোগে বয়ন শিল্পের মেলায় নিজের কারখানায় তৈরি সামগ্রী নিয়ে স্টল দিয়েছিলেন দেবব্রতবাবু। দেশের নানা জায়গার কটন, সিন্থেটিক, রেয়ন, চট-সহ বিভিন্ন বয়ন শিল্পের পসার ছিল সেখানে। জাতীয় জুট বোর্ডের অধীনে তিনি সেখানে যোগদান করেন। ‘বেস্ট ডিসপ্লে অ্যাওয়ার্ড’ও পেয়েছেন।

দেবব্রতবাবুর দাবি, প্রতি সামগ্রীর লভ্যাংশ থেকে ১৫ পয়সা সরিয়ে রাখা হয়। সেই অর্থ জমিয়ে দুঃস্থ পড়ুয়াদের বই দেওয়া থেকে শুরু করে সমাজসেবামূলক নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। তাঁর কারখানায় কাজ করে কর্মীরাও খুশি। দেবব্রতবাবু বলেন, “এখানে আমাকে কেউ স্যর বলেন না। বয়স অনুযায়ী কেউ দাদা বলে, কেউ বা নাম ধরে ডাকেন। আমার সংস্থায় সকলেই সমান। এক পরিবারের মতোই চলতে চাই।”

স্বপ্ন আজ অনেকটাই সত্যি হয়েছে তাঁর। এক সময়ের বেসরকারি সংস্থার কর্মী আজ ইন্টারনেটে বিদেশের সঙ্গে অহরহ যোগাযোগ স্থাপন করেন মফস্‌সলের অফিসে বসে। তাঁর কথায়, “সরকার যদি একটু পাশে দাঁড়ায়, তা হলে শিল্পটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।” কথার ফাঁকেই মাউস ক্লিক করে বিদেশের বাজারে ঘোরাঘুরি করতে থাকেন দেবব্রত।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE