কাটা রাস্তা মেরামতিতে হাত লাগিয়েছে পুলিশও। ভাঙড়ে সামসুল হুদার তোলা ছবি।
বিভ্রান্তি ছড়িয়ে উন্নয়নের কাজ থমকে দেওয়ার রাজনীতি যে তিনি বরদাস্ত করবেন না, প্রশাসনিক স্তরে তা আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাঙড়ে গত ৭২ ঘণ্টা ধরে পুলিশ ও শাসক দলের যে অভিযান চলেছে, তার মধ্যেও সেই বার্তা ছিল পরিষ্কার। এ বার আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার রেড রোডে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে ভাঙড়ের নাম মুখে না আনলেও মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আন্দোলনের নামে কেউ যদি সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে, সরকার ছেড়ে কথা বলবে না। ক্ষতিপূরণের টাকা তার কাছ থেকেই উসুল করা হবে। দরকার হলে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে সরকার।’’ এ ব্যাপারে সরকার আইন প্রণয়ন করবে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী।
মমতার এই হুঁশিয়ারির আগেই অবশ্য এ দিন ভাঙড়ে অবরোধ তুলে নেন আন্দোলনকারীরা। খামারআইট গ্রামে সাংবাদিক বৈঠক করে সিপিআই(এম এল) রে়ড স্টার-এর নেতা অলীক চক্রবর্তী বলেন, ‘‘অবরোধের কারণে সাধারণ মানুষের জীবিকার সমস্যা হচ্ছে। তা ছাড়া কয়েক দিন পরে মাধ্যমিক পরীক্ষাও শুরু হবে। সে জন্যই অবরোধ তুলে নেওয়া হচ্ছে।’’ তবে একই সঙ্গে তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘অবরোধ তুলে নিচ্ছি মানে আন্দোলন থেমে যাচ্ছে এমন নয়। আমরা আলোচনার মাধ্যমেই মীমাংসা চাই। কিন্তু পুলিশ বা শাসক দলের গুন্ডাদের দিয়ে গ্রামবাসীদের ভয় দেখানো হলে ফল ভাল হবে না।’’
ভাঙড়ের সমস্যা মেটাতে গ্রামবাসী ও রাজ্য সরকারের মধ্যে আলোচনা চেয়ে এ দিন রাজ্যপালের দ্বারস্থ হন কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের বিধায়কেরা। তাঁরা আলাদা আলাদা ভাবে কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন, আলোচনার প্রস্তাব সরকার মানছে না। এই অবস্থায় রাজ্যপাল যেন উদ্যোগী হন। অন্য দিকে, ভাঙড়ের দাবিদাওয়া নিয়ে ৩০ জানুয়ারি, সোমবার কলকাতায় মহামিছিল হবে বলে সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেন অলীক।
অলীকের ঘোষণার কিছু পরেই খামারআইট, মাছিভাঙা, বকডোবা-সহ ভাঙড়ের বিভিন্ন এলাকায় হাতে হাত লাগিয়ে রাস্তায় ফেলা রাখা গাছের গুঁড়ি বা ইটের পাঁজা সরিয়ে দেন গ্রামবাসীরা। রাজনীতিকদের একটা বড় অংশের মতে, ভাঙড়ে আন্দোলনের ধরন নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু সেখানে কৃষিজমি কেনাবেচা নিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে যে অসন্তোষ রয়েছে, তা ঘোর বাস্তব। গ্রামবাসীদের অনেকেই বলেছেন, পাওয়ার গ্রিডের ১৩ একর জমি অধিগ্রহণ নিয়ে তাঁদের তেমন আপত্তি ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে এলাকার প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক আরাবুল ইসলাম ও তাঁর দলবল যে ভাবে অবাধে জলের দরে কৃষিজমি দখল করেছে ও চড়া দামে তা প্রোমোটারদের কাছে বিক্রি করেছে, তাতেই ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়। জমি দখলের জন্য আরাবুল-বাহিনী কখনও বাড়ি বয়ে এসে হুমকি দিয়েছে, কখনও বা আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখিয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। ওই নেতাদের মতে, অলীকদের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গ্রামবাসীদের সেই রাগটাই বেরিয়ে পড়ছে।
প্রশ্ন হল, মুখ্যমন্ত্রী কি সেটা জানেন না? মমতা-ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের এক নেতা বলেন, গ্রামবাসীদের এই অসন্তোষ অবশ্যই আঁচ করতে পারছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং তা পারছেন বলেই প্রথম দিনই জানিয়ে দিয়েছেন কৃষক বা গ্রামবাসীদের আপত্তি থাকলে প্রকল্পের কাজ এগোনো হবে না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বুঝতে পারছেন যে, গ্রামবাসীদের এই অসন্তোষকে পুঁজি করে রাজনীতির জমি ফিরে পেতে চাইছে বিরোধী দলগুলি। ভাঙড় থেকে আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে রাজ্যের অন্যত্র। তাতে শুধু উন্নয়নের কাজ বাধা পাবে তা নয়, নৈরাজ্যের আশঙ্কাও রয়েছে।
ভাঙড়ে আন্দোলনের শুরুতে গ্রামবাসীরা শুধু পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। পরে রাতের অন্ধকারে পুলিশ দুই আন্দোলনকারীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে তাঁরা হিংসার পথ ধরেন। পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বাধে গ্রামবাসীদের। পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকটি গাড়ি ঠেলে ফেলে দেওয়া হয় রাস্তার পাশে নয়ানজুলিতে। ঘটনাচক্রে ভাঙড়ে বিক্ষোভ চলাকালীন প্রায় একই সময়ে বিষ্ণুপুরের রসপুঞ্জে একটি পথ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমার বেধে গিয়েছিল। সেখানেও স্থানীয় মানুষ পুলিশের ক্যাম্প অফিসে আগুন লাগিয়ে দেন। এ সব ঘটনায় নেতিবাচক মনোভাবের সংক্রমণই দেখছেন মুখ্যমন্ত্রী। রেড রোডের মঞ্চ থেকে সে জন্যই এ দিন কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘অনুরোধ করছি, কিছু রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় পা দেবেন না। অশান্তি লাগানো রাজনৈতিক দলের কাজ নয়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমরাও দীর্ঘদিন লড়াই করেছি, কিন্তু কোথাও এ সব করার প্রয়োজন হয়নি।’’
মমতার এই দাবি শুনে এ দিন তীব্র কটাক্ষ করেছেন বিরোধীরা। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় পুলিশ মমতার গাড়ি আটকানোর পরে তাঁর বিধানসভায় আসা ও সেখানে তৃণমূল বিধায়কদের তাণ্ডব, ভাঙচুরের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর প্রশ্ন, ‘‘সরকার কি এখন তৃণমূলের সেই সব নেতাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণ আদায় করবে!’’
বিক্ষোভের মাঝে কে সম্পত্তি নষ্ট করল, তা কী ভাবে বোঝা যাবে, সেই প্রশ্নও উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রীর অবশ্য দাবি, ‘‘তদন্ত করলে পুলিশ ঠিক ধরতে পারবে। পুলিশ সব বোঝে। ভিড়ের মধ্যে থেকে করলেও ধরা পড়বে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy