ময়না-তদন্তের পরে সিউড়ি হাসপাতাল থেকে দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মহম্মদবাজারে। (ডান দিকে) কাঁইজুলিতে লাশ ঢুকতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন পরিজন। —নিজস্ব চিত্র
দুই বোনের খুনের ঘটনায় পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এখনও স্পষ্ট হয়নি জোড়া খুনের ‘মোটিভ’ বা প্রকৃত কারণ।
তবে, এ বার নিহত সুস্মিতা ও পুষ্পিতার মা অপর্ণা সাধুকেও আটক করে টানা জেরা করছেন তদন্তকারীরা। একই সঙ্গে আটক করা হয়েছে অপর্ণাদেবীর ‘ঘনিষ্ঠ’ বন্ধু চণ্ডীচরণ লাহা নামে এক ব্যক্তি এবং সবিতা মাহারা নামে এক মহিলাকে। শুক্রবার রাত থেকে ৯টা থেকে ওই তিন জনকে মহম্মদবাজার থানায় রেখে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব চালিয়েছে জেলা পুলিশ। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ এক সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে মহম্মদবাজার থানায় এসে জেলার সিআইডি ইন্সপেক্টর প্রশান্ত কুমার নন্দীও ঘণ্টা দেড়েক জেরা করেন অপর্ণাদেবী-সহ আটক হওয়া তিন জনকে। এ দিনই বিকেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয় নিহত দুই বোনের ছোটো মামা রামপ্রসাদ সাহাকে।
কিনারা করতে না পারলেও জোর কদমে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। খুনের সূত্র খুজতে পুলিশ নিহতদের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোনটি আগেই বাজেয়াপ্ত করেছিল। এ বার অপর্ণাদেবীর মোবাইলও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তাঁর মোবাইলের কললিস্ট খতিয়ে দেখা হবে বলে পুলিশ সূত্রের খবর।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার বিকেল তিনটে নাগাদ থানায় আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ পাল। শুরু হয় সুস্মিতা-পুষ্পিতার কাকা, কাকিমা, খুড়তুতো ভাই, ঠাকুমা এবং গৃহশিক্ষক ও সহপাঠীকে ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদের পালা। রাত ৯টা নাগাদ অপর্ণাদেবীকে পুলিশ থানায় নিয়ে আসে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ওই রাতেই সিউড়ির আলুন্দা গ্রামের বাসিন্দা চণ্ডীরণ এবং স্থানীয় কুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা সবিতাকে থানায় আনা হয়। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ফিরে যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। শনিবার সকালের দিকে ছেড়ে দেওয়া হয় ঠাকুমা, খুড়তুতো দাদা, গৃহশিক্ষক ও নিহতদের সহপাঠীকে। তবে এ দিন সিউড়ি সদর হাসপাতালে দুই বোনের ময়নাতদন্ত হওয়ার পরে হাসপাতাল চত্বর থেকেই পুলিশ নিহতদের মামাকে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। শুক্রবার একটু বেলা হতেই থানার অফিসে ঢোকার গেট বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এ দিনও সকাল থেকে ওই গেট বন্ধ ছিল। দুপুর থেকে থানা চত্বরে ঢোকার মেন গেটও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই খুনের বিষয়ে জেলার সব পুলিশকর্তাই মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
তদন্তে নেমে পুলিশের সামনে অনেকগুলি খটকার একটি ছিল, ভর সন্ধ্যায় বাড়িতে ঢুকে দু’টি মেয়েকে খুন করে চলে গেল কেউ বা কারা। কিন্তু, দুই বোনের কাকার পরিবার বা দোতলার নীচে থাকা ভাড়াটে দোকানিরা কেউ কিছু শুনতে পেলেন না কেন?
ওই বাড়ির এক তলায় একটি কম্পিউটার সেন্টার আছে। তার মালিকের বাড়ি সুস্মিতাদের কাঁইজুলি হাইস্কুলের সামনে। তিনি বলেন, ‘‘রাস্তার ধারে আমাদের সেন্টার বা দোকান। বাড়ির ভিতর দিকে কী হয় না হয়, আমরা কিছুই বলতে পারব না। তা ছাড়া দিন কুড়ি ধরে সেন্টার বন্ধ আছে। তাই ঘটনার দিন ঠিক কী হয়েছিল, জানি না।’’ কাপড়ের দোকানদারের বক্তব্য, ‘‘দিন ২০-২৫ হল, আমি ওখানে দোকান করেছি। প্রথমে আমি ঘটনার কথা কিছুই জানতাম না। তার পর দেখি অনেক লোকজন, চিৎকার চেঁচামেচি। তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে দিই। আমিও লোকজনের সঙ্গে ভিতরে যাই।’’ তার আগে কি কোনও মেয়ের আর্তচিৎকার শুনতে পেয়েছিলেন? সে রকম কোনও আওয়াজ কানে আসেনি বলেই তাঁর দাবি।
এ দিন বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ দুই বোনের মৃতদেহ মহম্মদবাজারের কাঁইজুলি বাসস্টপ সংলগ্ন হাইস্কুল মাঠে এনে রাখা হয়। তাদের শেষ দেখা দেখতে ভিড় উপচে পড়ে সেখানে। এমন একটা ঘটনা এখনও ঠিক যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না এলাকার মানুষজন। সুস্মিতা ও পুষ্পিতা স্থানীয় ডাক্তার সুধাকৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ত। গত বুধবার দুই বোনের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। শুক্রবারও পরীক্ষা ছিল। তাদের স্মৃতিতে ওই দিন পরীক্ষা স্থগিত রাখেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অশোক ঘোষের কথা, ‘‘আমরা ওই পরিবারের সঙ্গে দেখা করে সান্ত্বনা জানিয়েছি। পুলিশের কাছে খুনিদের চরম শাস্তির দাবি জানিয়েছি।’’
পুলিশের কাছে ঘটনার পরে পরে অপর্ণাদেবী দাবি করেছিলেন, প্রায়ই বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি স্থানীয় কুমোরপুরের গোবিন্দ মন্দিরে পুজো দিতে যান। ঘটনার দিনও বিকেল ৫টা নাগাদ সেখানে গিয়েছিলেন। ওই সেবাইত সুবলচন্দ্র দাস এ দিন বলেন, ‘‘চণ্ডীচরণ ও অপর্ণাদেবী আমাদের শিষ্য ছিলেন না। মাঝেমধ্যে মন্দিরে আসতেন। কিন্তু, এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরের কুলিয়া গ্রামের সবিতা মাহারা আমাদের শিষ্যা ছিলেন। বছর দেড়েক হল তিনি মন্দিরে আসা কমিয়ে দিয়েছিলেন।’’ সুবলবাবু জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যার কিছু আগে অপর্ণাদেবী ও সবিতা মাহারা আম ও বাতাসা দিয়ে মন্দিরে পুজো দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে যান।
দুই মেয়ের খুনের তদন্তে নেমে পুলিশ তাঁরই স্ত্রী ও শ্যালককে আটক করেছে। সুস্মিতা-পুষ্পিতার শোকাহত বাবা দেবাশিস সাধুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমার চোখে ওঁরা দোষী নয়। তবে, আমি চাই পুলিশ তদন্ত করে অপরাধীদের গ্রেফতার করুক। দোষীরা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়, তা দেখুক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy