Advertisement
১৯ মে ২০২৪
Ram Navami and Hanuman Jayanti

রেখেছ বিজেপি করে বাঙালি করোনি! বাংলায় হনুমান জয়ন্তীর ধুমধামে কি ‘অস্ত্র’ গেল মমতার হাতে?

গত বিধানসভা নির্বাচনে ‘বহিরাগত’ আক্রমণে ফল পেয়েছিল তৃণমূল। রামনবমী আর হনুমান জয়ন্তীর গেরুয়া ধুমধাম কি সেই অস্ত্র আবার তুলে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে?

Is celebration of Ram Navami and Hanuman Jayanti will damage parties image in West Bengal

বিজেপির ধুমধাম করে রামনবমী আর হনুমান জয়ন্তীর পালনই কি মমতার অস্ত্র? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:১৭
Share: Save:

বিজেপি ‘বহিরাগত’দের নিয়ে এসে বাংলায় ভোট করাতে চাইছে। এমনটাই ছিল গত বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারের মূল সুর। আর তাঁর দলের স্লোগান ছিল, ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সর্বশক্তি দিয়ে প্রচারে নেমেছিলেন। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ ছাড়াও বাংলায় ভোটের প্রচারে এসেছিলেন যোগী আদিত্যনাথ থেকে শুরু করে তাবড় নেতারা। সেই কারণেই আরও বেশি করে ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব সাফল্য পেয়েছিল তৃণমূলের প্রচারে।

যে মহা ধুমধামে রামনবমীর পর হনুমান জয়ন্তীও পালন করছেন বিজেপির নেতানেত্রীরা, তাতে ‘অবাঙালি’ দলের তকমা তাদের গায়ে আরও সেঁটে বসছে। দলীয় নেতাদের একটা অংশ মনে করছেন, বৃহস্পতিবার দিনভর হনুমানের পুজো করে বিজেপি আরও এক বার বার্তা দিল, তারা বাঙালির প্রচলিত সংস্কৃতি থেকে বহু দূরে। একই সঙ্গে তারা মমতা তথা তৃণমূলকে ‘ঠিক’ বলে প্রমাণ করল আরও এক বার।

বাংলা মানে রবীন্দ্র জয়ন্তী। বাংলা মানে নজরুল জয়ন্তী। সেখানে হনুমান জয়ন্তী কেন? বিজেপি নেতানেত্রীদের ঘটা করে হনুমান জয়ন্তী পালন করাটা কি ভুল? প্রকাশ্যে না-বললেও রাজ্য বিজেপি নেতাদের ‘দায়িত্বশীল’ অংশ মনে করেন, ভুল। তাঁরা আরও মনে করেন, মমতা সুকৌশলে তাঁদের এই অবাঙালিত্বের ‘ফাঁদে’ ফেলে দিয়েছেন। যাতে বিজেপি বার বার রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তীর মতো পরব পালন করে বাংলা এবং বাঙালির সংস্কৃতি থেকে আরও দূরে সরতে থাকে। বস্তুত, রাজ্যে বিজেপি নেতাদের একটি অংশ মনে করেন, বিজেপি যে ভাবে মমতার ‘ফাঁদে’ পা দিয়েছে, তাতে ভোটের আগেই জিতে বসে থাকবেন মমতা!

গত বিধানসভা নির্বাচনে নবান্ন দখলের প্রত্যাশা ছিল বিজেপির। কিন্তু ভোটের পরে দেখা যায়, সেই প্রত্যাশা থেকে অনেক দূরে রয়ে গিয়েছে তারা। সেই সময় এমন বিশ্লেষণও দলের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় এসেছিল যে, দলের ভাবমূর্তিতে বদল আনতে হবে। অনেকে বলেছিলেন, বাংলার মানুষের মন জয় করতে হলে দলের আচার-আচরণ, উৎসব-পার্বণ সবের মধ্যেই বাঙালিয়ানা আনতে হবে। যেমন দলীয় কর্মীকে ‘কার্যকর্তা’ না বলে কর্মী বলতে হবে। অন্য সব রাজনৈতিক দল যেমন বলে। তবে সে সব যুক্তি ধোপে টেকেনি। কারণ, বিজেপির ঘোষিত নীতি— ‘আমরা আগে ভারতীয়, তার পরে বাঙালি।’ তাই দলের স্লোগানে অধিকাংশ সময়েই হিন্দির ছায়া থাকে। শুভেন্দু অধিকারী নরেন্দ্র মোদীর নাম নেওয়ার আগে ‘যশস্বী প্রধানমন্ত্রী’ বলেন। ‘কর্মী’-রা ‘কার্যকর্তা’ থেকে যান।

বাংলার বিজেপি কি ‘হিন্দিভাষীদের দল’ হয়েই থাকতে চাইছে? প্রত্যাশিত ভাবেই এটা মানতে নারাজ রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি শুধু হিন্দিভাষীদের কেন হতে যাবে? বিজেপি তো ভারতের সব ভাষাভাষীদের দল! গুজরাতি, রাজস্থানি, অসমিয়া, তামিল, তেলুগু— কোন ভাষাকে বাদ দেবেন? বড় অংশের বাংলা ভাষাভাষীর ত্রিপুরাও তো বিজেপির!’’

শমীক তাঁর মতো করে যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু বিজেপি নেতারা জানেন, ত্রিপুরার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক রয়েছে। সেই সূত্রেই দলের একটা অংশ মনে করছেন, রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তী পালনে এত গুরুত্ব দিয়ে বিজেপি নিজের পায়েই কুড়ুল মেরেছে। যা তৃণমূলের হাতে আরও এক বার ‘বহিরাগত’ অস্ত্র তুলে দিয়েছে। বিজেপির ওই নেতারা এমনও মনে করছেন যে, মমতার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন দলীয় নেতৃত্ব। এই অভিমতে বিশ্বাসী এক নেতার কথায়, ‘‘বিজেপি রামনবমীতে গোলমাল পাকাতে পারে, হনুমান জয়ন্তীতে উস্কানি দিতে পারে বলে আগে থেকেই প্রচারে নেমে গিয়েছিল তৃণমূল। আমাদের নেতৃত্ব মনে করেছিলেন, দলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে চাইছে তৃণমূল। কিন্তু সেটা ছিল গুগলি। ব্যাট চালাতে গিয়ে ক্যাচ উঠে গিয়েছে।’’

পুরোপুরি স্বীকার না করলেও এই ধরনের ‘অবাঙালি’ পার্বণ ঘটনা করে পালন করতে গিয়ে বিজেপি যে কিছুটা হলেও ফাঁদে পড়ে গিয়েছে, তার ইঙ্গিত রয়েছে শমীকের কথায়। তিনি বলেছেন, ‘‘বিজেপি তো রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তীতে কোথাও মিছিল করেনি। তৃণমূল এবং তথাকথিত প্রগতিশীল বামপন্থীরা এমন একটা প্রচার করছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে।’’ বিজেপির বিভিন্ন নেতাকে নানা মিছিলে দেখা যাওয়ার প্রসঙ্গে শমীক বলেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মিছিলে ঘোষিত ভাবে অংশ নিয়েছি। যেখানে যেখানে ভারতের সনাতন সংস্কৃতির ধারকরা আক্রান্ত হয়েছেন, সেখানে তাঁদের রক্ষা করতে গিয়েছি। এটা আমাদের কর্তব্য।’’ একই সঙ্গে শমীকের দাবি, বাংলায় এখন হিন্দিভাষী ভোটারের সংখ্যাও কম নয়। তিনি বলেন, ‘‘বাংলার যেটুকু শিল্প বেঁচে রয়েছে, তা বিহার, উত্তরপ্রদেশ-সহ অন্যান্য রাজ্যের শ্রমিকদের জন্য। বাংলার মেধা চলে গিয়েছে অন্য রাজ্যে। এখন এখানে থাকা হিন্দিভাষীদের আবেগের পাশে দাঁড়ালে বাঙালিত্ব নষ্ট হয়ে যায়, এমন মনে করার কোনও মানে হয় না।’’

তর্কের খাতিরে প্রকাশ্যে রাজ্য বিজেপির সমস্ত নেতা এমনই বলবেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু একান্ত আলোচনায় তাঁদেরই একাংশ স্বীকার করছেন যে, গোলমাল হয়ে গিয়েছে। মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল একটা সময়ে ঘটা করে রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তী পালন করা শুরু করেছিল। তা দেখেই বিজেপি আরও তোড়জোড় করে ওই দু’টি দিন পালন করতে শুরু করে। কিন্তু এতে যে বাংলা এবং বাঙালির দৈনন্দিন সংস্কৃতির থেকে তাদের দূরত্ব আরও বাড়ছে, সেটা দলীয় নেতাদের একাংশ বুঝতে পারেননি। যখন বুঝেছেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। পিছিয়ে আসারও পথ নেই। ফলে ঘটা করে হনুমানের পুজো করতে হচ্ছে। রাজ্যের জনতা বলছে, রেখেছ বিজেপি করে, বাঙালি করোনি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE