ভগিনী নিবেদিতার বাড়ির সেই উঠোন
সে-ও ছিল এক কালীপুজোর দিন। বাগবাজারের সেকেলে দোতলা বাড়িটার দালানে ঘট বসিয়ে পুজো সারলেন স্বয়ং সারদামণি। ভারত-উপাসিকা এক আইরিশ নারীর মহতী স্বপ্নেরও সেটাই সূচনা। স্কুল গড়ে এ দেশের মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করতে তাঁর সঙ্কল্পটি সে-দিন ডানা মেলল।
সেটা ১৮৯৮ সালের কথা। সেই ঐতিহাসিক উঠোন এতদিন বাদে এ দেশের আমজনতার জন্য খুলে দেওয়া গিয়েছে। একদা ভগিনী নিবেদিতার ঠিকানা, ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িটায় সংগ্রহশালা তৈরির কাজ
চলছে পুরোদমে।
বাড়িটার বর্তমান ঠিকানা অবশ্য ১৬এ মা সারদামণি সরণি। রাজ্য সরকারের তৎপরতায় বহু দিনের ভাড়াটেদের সরিয়ে তিন বছর আগেই রামকৃষ্ণ সারদা মিশনের হাতে বাড়িটি তুলে দেওয়া হয়েছে। দু’দিন আগে শুক্রবার, ভগিনী নিবেদিতার ১৪৯ তম জন্মদিন থেকেই কলকাতার প্রাচীন এই বাড়িটায় যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। শনি-দুপুরে সেটাই বলছিলেন, সারদা মঠ ও রামকৃষ্ণ সারদা মিশনের সন্ন্যাসিনীরা। ‘‘এ বাড়ি অধিগ্রহণের পরে তার ইতিহাসের উত্তরাধিকার নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার কাজটা বলতে পারেন, সিস্টারের জন্মদিন থেকেই শুরু হল।’’ তাঁরা জানালেন, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়িটায় সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র শীঘ্রই তৈরি হবে। আর কয়েক দিন বাদেই নানা অনুষ্ঠানে এ তল্লাটে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজকর্ম চলতে থাকবে।
এ বাড়ির দালানে নিবেদিতার ছবি অবশ্য এখন আর রাখা নেই। তবে গেরুয়া-সাদা কাপড়ের সাজটা অটুট। আর রয়েছে লাল, গোলাপি, হলুদ, সাদা জারবেরা ফুলের সমারোহ। নিবেদিতার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যে ভাবে নানা রঙে দালানটা সাজানো হয়েছিল।
দালান থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ির নীচে যেখানে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসিনীরা কথা বলছেন, সেই উঠোনটাও বাংলা-বাঙালির ইতিহাসের এক বিচিত্র স্মারক। উনিশ শতকের শেষ দিকের এক বিকেলে সেখানেই মুখোমুখি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বামী বিবেকানন্দ। নরেন্দ্রনাথ দত্ত বিবেকানন্দ হওয়ার পরে সম্ভবত সেটাই দু’জনের প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ। ১৮৯৮-এর নভেম্বর থেকে ১৮৯৯-এর জুন পর্যন্ত ক’টা মাস বাগবাজারের এই বাড়িতে ছিলেন বিবেকানন্দ-শিষ্যা নিবেদিতা। এখানে থেকেই এ দেশের জনপদবাসী মানুষজনকে কাছে টেনে তাঁদের পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন আইরিশ তরুণী। তাঁর সৌজন্যে পরতের পর পরত ইতিহাস মিশে গিয়েছে এ বাড়ির শরীরে।
এই দালানেই ঘট বসিয়ে পুজো করেছিলেন সারদাদেবী।
শনিবার ছবিটি তুলেছেন স্বাতী চক্রবর্তী।
রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের মোলাকাতের উঠোনটিই আবার রামকৃষ্ণ মিশনের সেবাকাজেরও আদি চারণভূমি। ১৮৯৯ সালে কলকাতার প্লেগ মহামারীতে নিবেদিতাকে পুরোভাগে রেখে শুরু হয় মিশনের প্রতিরোধ ও সেবাকাজ। নিবেদিতার বাড়ির উঠোন থেকেই শুরু হয় সে পথ চলা। উঠোনের ও-পাশে ১৬ বাই সাত ফুটের ছোট্ট ঘরটা নিবেদিতার স্টাডি। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, বালগঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ ঘোষ থেকে তৎকালীন ভারতের কেউকেটারা অনেকেই যেখানে এসেছেন। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তদের পরিমণ্ডলে খুব চেনা একটি ছবিতে দেখা যায় সদ্য বিলেত-আমেরিকা প্রত্যাগত দিগ্বিজয়ী বিবেকান্দ বসে আছেন একটি রোয়াকে। সঙ্গে গুরুভাই রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), মহাপুরুষ মহারাজ (স্বামী শিবানন্দ), হরি মহারাজ (স্বামী তুরীয়ানন্দ), সারদা মহারাজ (স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ) প্রমুখ। সেটা নিবেদিতার ওই স্টাডিরুমেরই রোয়াক। ছবিতে ধরা পড়া পুরনো জলের পাইপের চেহারাটা অবধি এখনও অবিকল।
নিবেদিতার এই বাড়ির সংস্কার-কাজে রামকৃষ্ণ সারদা মিশনের কমিটির অন্যতম সদস্য তথা শিল্প-স্থাপত্য সংরক্ষণবিদ অরুণ ঘোষ বলছিলেন, শামুকের চুন ও অন্য উপকরণ মিশিয়ে বাড়িটার দেওয়াল ‘লাইমপ্যানিং’-এর কাজ আর কয়েক দিনেই শেষ হবে। লোকজনের যাতায়াত বাড়লে মেঝের ক্ষয় রোধে দরকারি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। ওই বাড়ির পিছনেই তৎকালীন ১৭ নম্বর বোসপাড়া লেনেও জীবনের শেষ কয়েকটা বছর থেকেছেন নিবেদিতা। সে বাড়ি অবশ্য এখনও অধিগ্রহণ করা যায়নি। তবে ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িতে সংগ্রহশালা গড়ার কাজ শেষের মুখে।
সন্ন্যাসিনীরা বলছিলেন, নিবেদিতার বাড়িতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কিন্তু এখনই শুরু হয়ে যাচ্ছে। আগামী ১২ নভেম্বর থেকেই চালু হবে, ‘নিবেদিতা— আত্মোৎসর্গের অন্য নাম’ শীর্ষক প্রদর্শনী। আয়োজনে রামকৃষ্ণ সারদা মিশন ও সিস্টার নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়। সারদামণির পুজোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সে দিনের স্কুল, আজকের নিবেদিতা গার্লসের পড়ুয়ারা নানা অনুষ্ঠানে সামিল হবেন। বাগবাজারের পল্লিবাসী তথা স্থানীয় সংস্কৃতিমোদীদের উৎসাহে নিবেদিতার আসন্ন সার্ধ শতবর্ষ উপলক্ষে একগুচ্ছ অনুষ্ঠান, বিদগ্ধ আলোচনা-সভাও প্রায় একই সময়ে শুরু হয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy