Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

খাস শহরেই ‘ডাইনি’ অপবাদে নারী-নিগ্রহ

কোনও গণ্ডগ্রাম নয়, খাস কলকাতার বুকে টালিগঞ্জ থানা এলাকায় এক প্রৌঢ়াকে ‘ডাইনি’ অপবাদে গণপিটুনি দেওয়ার অভিযোগ উঠল। ওই মহিলা ‘ডাইনিবিদ্যা’ প্রয়োগ করে প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েকে অসুস্থ করে দিচ্ছেন, এই অভিযোগে গত বুধবার রাতে তাঁর উপরে চড়াও হয় কিছু লোক। তাঁকে চুলের মুঠি ধরে টেনে-হিঁচড়ে বার করে বুকে-মুখে এলোপাথাড়ি ঘুষি-লাথি মারা হয় বলে অভিযোগ। মহিলা অসুস্থ হয়ে ক্রমশ নেতিয়ে পড়েন। এমনকী, তাঁর বাড়ির শিশুদেরও মারা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

‘ডাইনি’ অপবাদে মহিলাকে নিগ্রহের ঘটনার পরে থমথমে সেই পাড়া। বৃহস্পতিবার।— নিজস্ব চিত্র

‘ডাইনি’ অপবাদে মহিলাকে নিগ্রহের ঘটনার পরে থমথমে সেই পাড়া। বৃহস্পতিবার।— নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:৪৫
Share: Save:

কোনও গণ্ডগ্রাম নয়, খাস কলকাতার বুকে টালিগঞ্জ থানা এলাকায় এক প্রৌঢ়াকে ‘ডাইনি’ অপবাদে গণপিটুনি দেওয়ার অভিযোগ উঠল। ওই মহিলা ‘ডাইনিবিদ্যা’ প্রয়োগ করে প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েকে অসুস্থ করে দিচ্ছেন, এই অভিযোগে গত বুধবার রাতে তাঁর উপরে চড়াও হয় কিছু লোক। তাঁকে চুলের মুঠি ধরে টেনে-হিঁচড়ে বার করে বুকে-মুখে এলোপাথাড়ি ঘুষি-লাথি মারা হয় বলে অভিযোগ। মহিলা অসুস্থ হয়ে ক্রমশ নেতিয়ে পড়েন। এমনকী, তাঁর বাড়ির শিশুদেরও মারা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

খবর পেয়ে রাতেই টালিগঞ্জ থানার পুলিশ আসে। দু’জন পুলিশকর্মীকে এলাকায় মোতায়েন করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে হামলাকারীরা ফের ওই প্রৌঢ়াকে মারধরের চেষ্টা করলে পুলিশ কোনওমতে তাঁকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশই ঘটনাটি নথিভুক্ত করে রেখেছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, মননে যে কলকাতাকে নিয়ে এত গর্ব, সেখানে এমন ঘটনায় উদ্বিগ্ন সমাজতাত্ত্বিক থেকে শুরু করে মনোবিদ ও প্রশাসনের অনেকেই।

কেন ডাইনি অপবাদ দেওয়া হল ওই প্রৌঢ়াকে?

এলাকা সূত্রের খবর, টালিগঞ্জ রোডের জমাদার বস্তিতে দুই মেয়ে-জামাই এবং নাতি-নাতনিদের সঙ্গে থাকেন ওই মহিলা। কয়েক বছর আগে তাঁর এক বোন মারা গিয়েছেন। বুধবার রাতে ওই বস্তিরই এক বাসিন্দা দলবল নিয়ে তাঁদের উপরে চড়াও হয়। সে দাবি করে, ওই প্রৌঢ়া আসলে ডাইনি। এবং ঝাঁড়ফুক করে নিজের মৃত বোনের আত্মা নামিয়ে তার মেয়ে নেহার দেহে ঢুকিয়ে তাকে অসুস্থ করে দিয়েছেন। আক্রান্ত মহিলার বড় মেয়ের অভিযোগ, “বুধবার রাতে খাওয়ার পরে আমরা একসঙ্গে বসে গল্প করছিলাম। আচমকাই ওই ব্যক্তি বেশ কিছু লোকজন নিয়ে আসে। দরজা খুলতেই ওরা মাকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে।” অভিযুক্তকে এ দিন অবশ্য পাওয়া যায়নি। তার বাড়ির লোকেরাও কথা বলতে চাননি।

সমাজতাত্ত্বিক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়, অভিজিৎ মিত্রেরা এর মধ্যে অন্য অভিসন্ধি খুঁজে পাচ্ছেন। রামানুজের কথায়, “ডাইনি বলতে যে গুণাবলী আরোপ করা হয়, তার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সামাজিক অভিসন্ধি পূরণের জন্যই এ ধরনের তকমা দিয়ে দেওয়া হয়।” অভিজিৎবাবু আবার মনে করছেন, “শহর বলেই যে সকলে সভ্য এবং কুসংস্কারমুক্ত, তা মনে করা যাবে না। শহুরে অসভ্যকে বোঝা যথেষ্ট মুশকিল। আসল কারণ হয়তো অন্য, মানুষ সেটা চাপা দিয়ে অন্যত্র নিজের রাগ দেখাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবে ভাবার অবকাশ আছে।”

একই অনুভব ডাইনিবিদ্যা বিশারদ ঈপ্সিতা রায় চক্রবর্তীর। তিনিও মনে করেন, ‘ডাইনি’ শব্দটা সামনের একটা আবরণ মাত্র। এর পিছনে যেমন লিঙ্গবিবাদ কাজ করে, তেমন রয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়। এক জন মহিলাকে যখন অনেকে মিলে ডাইনি অপবাদ দিচ্ছে, তখন দেখতে হবে সেই মহিলার কোনও সম্পত্তি, জমিজমা, গয়না হাতানোর উদ্দেশ্য তাঁদের রয়েছে কি না। ঈপ্সিতা মনে করেন, মহিলা যদি কমবয়সী হন, তা হলে হয়তো তিনি কাউকে যৌনলিপ্সা পূরণে বাধা দিয়েছিলেন। সেই প্রতিহিংসাবশত তাঁকে ডাইনি অপবাদ দিতে পারে। ঈপ্সিতার কথায়, “আমি এক বার পুরুলিয়ার গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে লোকজন আমাকে পাথর মেরেছিল। আমাকে গ্রামের মেয়ে-বৌদের সঙ্গে কথা বলতে দেয়নি।” মহিলাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা শাশ্বতী ঘোষের মনে পড়ে যাচ্ছিল বছর তিনেক আগের কথা। সে সময়ে উত্তর কলকাতায় ডাইনি অপবাদে এক মহিলাকে হেনস্থা করা হয়েছিল। শাশ্বতী মনে করেন— বস্তি অঞ্চলে যেখানে অনেক মানুষ খুব কাছাকাছি, ঘেঁষাঘেঁষি করে বাস করেন, সেখানে কোনও একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁদের খেপিয়ে তোলা অনেক সহজ, যেটা এ ক্ষেত্রে হয়েছে।

এই অনেককে খেপিয়ে তোলা বা ‘মাস হিস্টিরিয়া’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মনোবিশেষজ্ঞ অমরনাথ মল্লিক বলেন, “কিছু কুসংস্কার বা ভুল ধারণা মানুষের মধ্যে গেড়ে বসে। তাকে আরও বেশি হাওয়া দিলে মন যুক্তি-তর্কের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে কিছু কাজ করতে পারে।” আবার মনোবিদ মোনালিসা ঘোষের মতে, “আগ্রাসন বা রাগ প্রকাশের একটা চাহিদা মানুষের মধ্যে থাকে। সুযোগ পেলে সেটাই গণ হিস্টিরিয়ার রূপ নেয়।” এটা যে শুধু গ্রামাঞ্চলে হয় তা নয়, শহরাঞ্চলে সমান ভাবে দেখা যায়। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় যেমন বলছিলেন, “শহরের মানুষও তান্ত্রিক, কবজ, মাদুলি, বাচ্চাদের ঝাড়ানোর পিছনে ছোটে। তা হলে ডাইনিতে বিশ্বাস করবে না কেন? আসলে পাড়ায় পাড়ায় বিজ্ঞানচর্চা উঠে যাচ্ছে, স্বচ্ছ যুক্তি-চিন্তা সব হারিয়ে যাচ্ছে।”

যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেই ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস কাউন্সিলর মালা রায় বলেন, “মানুষের সচেতনতার অভাব আছে। এমন আর যাতে না ঘটে, তার জন্য আমি ধারাবাহিক প্রচারও চালাব।’’ এলাকার তৃণমূল বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “পুলিশকে বলেছি, রাজনৈতিক তকমা না দেখে যারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের ধরে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE