Advertisement
১৬ মে ২০২৪

রকসিডে রক্ষে নেই, দোসর ব্ল্যাক ক্যাটও 

মন ভরবে না রকসিডেও? এর বেশি হলে নিজের কানেই তালা লেগে যাবে যে। তবু ইচ্ছে হলে সঙ্গে যাক ব্ল্যাক ক্যাট। 

 দেদার বিকোচ্ছে শব্দবাজি। ছবি: সুদীপ ঘোষ

দেদার বিকোচ্ছে শব্দবাজি। ছবি: সুদীপ ঘোষ

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৮ ০১:২৮
Share: Save:

কী চাই? রকসিড? না কি একটু কম শব্দ? তবে কয়েক প্যাকেট বুড়িমা যাক সঙ্গে।

মন ভরবে না রকসিডেও? এর বেশি হলে নিজের কানেই তালা লেগে যাবে যে। তবু ইচ্ছে হলে সঙ্গে যাক ব্ল্যাক ক্যাট।

উত্তর ২৪ পরগনায় বারাসত-ব্যারাকপুর রোড থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার এগোলে নারায়ণপুর মোড়। সেখান থেকে বাঁ দিকে গেলে পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ডান দিক ধরে এগোলেই পরপর বাজির দোকান। এক-একটি রাস্তার দু’ধারেই সার দিয়ে হরেক রকমের বাজির সম্ভার নিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। মালবাহী গাড়ি ভর্তি করে কলকাতার বাজি বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা। আবার নিজস্ব গাড়ি, মোটরসাইকেল নিয়ে এসে বাড়ির জন্য বাজি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকেই।

চকলেট বোমা পাওয়া যাবে? সেখানকার একটি দোকানে গিয়ে প্রশ্নটা ফেলতেই সপাটে জবাব এসেছিল, ‘‘না। শব্দবাজি নিষিদ্ধ। তাই এখানে বিক্রি হয় না।’’ পরে এক ক্রেতার কাছে প্রচুর শব্দবাজি দেখে জানা গেল, চকলেট বোমা-টোমা চাইলে কোনও দোকানেই মিলবে না। তবে? বলতে হবে ‘রকসিড’ চাই। তার চেয়ে কম জোরালো কিছু লাগলে বলতে হবে ‘বুড়িমা’। মিটল সমস্যা। রকসিড চাইতেই এ বার হাঁকডাক পরে গেল, “দাদা, এ দিকে আসুন। কানে তুলো গুঁজে না ফাটালে নিজের কানেই তালা লেগে যাবে। গ্যারান্টি!’’ বাক্স-বাক্স রকসিড বার করে দিলেন মহম্মদ সাইফার নামে এক দোকানি। অনেকটা চকলেট বোমার আকারের এই বাজির শব্দমাত্রা প্রায় ১৫০ ডেসিবল। সাইফার আরও জানান, এখানে এক বাক্স (১২টি থাকে) হিসেবে বিক্রি হয় না। কমপক্ষে ১২ বাক্স কিনতে হবে। দাম ২২০ টাকা। জানা গেল, আরও জোর শব্দের বোমাও মিলবে। নাম, ‘ব্ল্যাক ক্যাট।’ এমন ভাবেই বেঁধে দেওয়া হবে, যাতে কেউ টের না পায়। উপরে থাকবে আতসবাজি, নীচে রকসিড, ব্ল্যাক ক্যাট, বুড়িমা।

দোকানের পিছনের একটি বাড়িতে পেল্লায় সাইনবোর্ডে লেখা, ‘আতসবাজির কারখানা’। ভিতরে এক দিকে রাখা বারুদ, সুতো, বাজি। সামনের দিকের ঘরগুলিতে তৈরি হচ্ছে চুরবুড়ি, চরকা, রংমশাল, কালীপটকার মতো বাজি। পিছনের ঘরগুলিতে বাইরে থেকে তালা দেওয়া। এলাকায় ঘুরে জানা গেল, সেই ঘরেই স্কুলপড়ুয়া থেকে মধ্য বয়সিদের দিয়ে তৈরি হচ্ছে দোদোমা, চকলেটের মতো নিষিদ্ধ শব্দবাজি। বস্তাবন্দি হয়ে সেই বাজি পৌঁছে যাচ্ছে কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন পাইকারি বাজি বাজারে।

অনেকটা কুটির শিল্পের ধাঁচেই ঘরে ঘরে বাজি তৈরির কারখানা উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত সংলগ্ন নীলগঞ্জের নারায়ণপুরে। বাজি কারখানার সংখ্যা কত, হিসেব নেই পুলিশ-প্রশাসনেও। সম্প্রতি দত্তপুকুর থানার পুলিশ হানা দিয়ে কয়েক কুইন্টাল নিষিদ্ধ শব্দবাজি ও বাজি তৈরির মশলা উদ্ধার করে। যার বাজারমূল্য কয়েক লক্ষ টাকা বলে জানিয়েছে পুলিশ। স্থানীয়দের অভিযোগ, বাজেয়াপ্ত করা বিপুল পরিমাণ বাজিই প্রমাণ করে ওই এলাকায় বাজি কারবারের ব্যাপ্তি। আরও অভিযোগ, দীপাবলির সময়ে পুলিশ কিছু বাজি বাজেয়াপ্ত করে। তবে সেটা লোকদেখানোই।

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ৯০ ডেসিবেলের উপরে উঠবে না বাজির শব্দমাত্রা। এ ধরনের বাজি ফাটালে, বিক্রি করলে কিংবা তৈরি করলে পুলিশ সেই ব্যক্তিকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করতে পারে। অথচ নারায়ণপুরে যে সব বাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, তার শব্দমাত্রা ১২০ ডেসিবেলের অনেক বেশি।

কেবল শব্দদূষণই নয়, রয়েছে অন্য সমস্যাও। বস্তুত, বারুদের স্তূপের উপরে বসে থাকা নারায়ণপুরে বিস্ফোরণে মৃত্যু বা হাত-পা ঝলসে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে নিয়মিত। স্থানীয়দের অভিযোগ, কাঁচা টাকার লোভ দেখিয়ে নাবালকদের কাজে লাগিয়ে মুনাফা লোটেন ব্যবসায়ীরা। বছর দুই আগে সেখানে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় রাহুল দাস নামে নবম শ্রেণির এক ছাত্রের। এর আগে সেখানেই বাজি বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় তিন নাবালকের।

এলাকায় বাজি মালিকদের দাপট যে চরম, তা বলছে পুলিশও। পুলিশের দাবি, বাজি বাজেয়াপ্ত, এমনকি, কারখানার মালিক গ্রেফতারের পরেও বন্ধ হচ্ছে না নিষিদ্ধ বাজি তৈরি। পুলিশ সূত্রে খবর, এলাকার বাজি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে সতর্ক করাও হয়েছিল। শব্দদূষণের ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে প্রচারও হয়েছিল। কিছুতেই কাজ হয়নি। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মাঝেমধ্যেই ওই এলাকায় হানা দিয়ে ধরপাকড় চলে। কারখানা ভেঙেও দেওয়া হয়। ফের অবৈধ ভাবে নিষিদ্ধ বাজি তৈরি শুরু হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE