সহমর্মী: ফুটপাতে ভিক্ষাপাত্র হাতে বসে শেখ নাসের। শুক্রবার, ধর্মতলায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
এক হাতে লাঠি। অন্য হাতে বাটি। ফুটপাতে রাখা একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ভিক্ষা করছেন এক বৃদ্ধ। এ শহরে এমন ভিক্ষাজীবী তো কতই আছেন। কিন্তু শেখ নাসের নামে চাঁদনি চক এলাকার ওই বৃদ্ধ ভিক্ষাজীবী অন্যদের থেকে অনেকটাই আলাদা। গত চার বছর ধরে তিল তিল করে জমানো ১৪ হাজার টাকা বেওয়ারিশ দেহের শেষকৃত্য করার জন্য তিনি দান করে দিয়েছেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে।
অন্যান্য দিনের মতো শুক্রবার দুপুরেও ভিক্ষা করছিলেন শেখ নাসের। বৃদ্ধ জানালেন, তাঁর এখন তিন কুলে কেউ নেই। খাওয়ারও খরচ নেই। খাবার জুটে যায় চাঁদনি চক এলাকারই রাস্তার একটি হোটেল থেকে। জামাকাপড়ও পেয়ে যান কারও না কারও কাছ থেকে।
নাসের বললেন, ‘‘রোটি, কাপড়া তো জুটেই গেল। আর মকান তো এই ফুটপাত। তাই আমার চিন্তা কী? গত চার বছর ধরে যে টাকা ভিক্ষাবৃত্তি করে পেয়েছি, তার পুরোটাই দান
করে দিয়েছি।’’
আসবাবপত্র তৈরির একটি কারখানায় মোটবাহকের কাজ করতেন নাসের। বললেন, ‘‘আট বছর আগে রাস্তায় একটি দুর্ঘটনায় ডান পা মারাত্মক ভাবে জখম হয়। তার পর থেকে আর কোনও কাজ করতে পারতাম না। মা-বাবা মারা গিয়েছেন অনেক আগেই। স্ত্রী আর দুই ছেলে ছিল। ওরাও বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। তিন কুলে কেউ নেই আমার। কাজও করতে পারি না। তাই ভিক্ষাবৃত্তিই বেছে নিলাম।’’
নাসের জানান, দুর্ঘটনার পরে কিছু দিন তিনি তিলজলার একটি হোমে ছিলেন। কিন্তু সেখানে থাকতে ভাল লাগছিল না। তাই হোম থেকে এক দিন বেরিয়ে আসেন। এক পায়ে ভাল করে চলতে পারতেন না বলে কোনও কাজও পাননি। তাই ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না।
কথা বলতে বলতেই দেখা গেল, নাসেরের বাটিতে এক, দুই বা পাঁচ টাকা করে দিয়ে যাচ্ছেন পথচারীরা। নাসের বলেন, ‘‘ভিক্ষা করে দিনে একশো থেকে দুশো টাকা তো হয়েই যায়। এক-এক দিন চার-পাঁচশো টাকাও হয়। চার বছরে আমি এই ভাবে ১৪ হাজার টাকা জমিয়েছিলাম।’’
বছর পঁচাত্তরের বৃদ্ধ আরও জানিয়েছেন, দায়দায়িত্ব বা খরচ তেমন নেই বলে তাঁর অনেক দিনেরই ইচ্ছে ছিল, ভিক্ষা করে জমানো টাকা কোনও সমাজসেবামূলক কাজে দান করবেন। চাঁদনি চকের যে ফুটপাতে বসে গত কয়েক বছর ধরে তিনি ভিক্ষা করছেন, তার খুব কাছেই রয়েছে জামাকাপড়ের একটি দোকান। ওই দোকানের মালিক রহমান সরকারের সঙ্গে তাঁর ভাব জমে গিয়েছিল গত কয়েক বছরে। রহমানকে নিজের ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলেন নাসের।
রহমান বলেন, ‘‘ওঁর ইচ্ছের কথা শুনে প্রথমে খুব অবাক হয়ে যাই। এ-ও বুঝতে পারি, উনি টাকাটা দান করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে উনি টাকাটা দিতে চাইছিলেন, তাদের ঠিকানা বেনিয়াপুকুর থানা এলাকায়।
ওই থানারই এক অফিসার সেই টাকা ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।’’ এই কাজে নাসেরকে সাহায্য করেন রহমান। বেলা গড়ায়। নাসেরের ভিক্ষাপাত্রে জমতে থাকে দিনের সঞ্চয়। বৃদ্ধ জানান, অর্থের প্রতি মোহ চলে গিয়েছে তাঁর। ভিক্ষা করে তিল তিল করে আবার যে টাকা তিনি জমাবেন, তা-ও ফের দান করে দেবেন জনসেবামূলক কোনও কাজে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy