Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Cerebral Palsy

Cerebral Palsy: কোভিডে প্রাণ বাঁচিয়ে জীবনযুদ্ধ ছাড়লেন তিনি

কন্যাহারা পিতা শুক্রবার বললেন, ‘‘মেয়ের জন্য বাড়িতে ছোটখাটো একটা হাসপাতালই তৈরি করতে হয়েছিল।

অতীত: ভাই অরুণাদিত্যের সঙ্গে অভিষিক্তা।

অতীত: ভাই অরুণাদিত্যের সঙ্গে অভিষিক্তা। ছবি পরিবার সূত্রে প্রাপ্ত

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:১১
Share: Save:

মাসকয়েক আগের কথা। কোভিডের বাড়বাড়ন্তে শহরে অক্সিজেনের হাহাকার। আকাশছোঁয়া দরে বিকোচ্ছে এক-একটি সিলিন্ডার। প্রায়ই অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর খবর আসছে। তার মধ্যেই উঠেছে অক্সিজেন নিয়ে কালোবাজারির অভিযোগ। ব্যবসায়ীদের একাংশের দায়িত্ববোধ ও মানবিকতা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছে, তখনই তৈরি হয়েছিল মানবিকতার অন্য এক নজির। গলায় ফুটো করে ঢোকানো অক্সিজেনের নল ছাড়া যে মেয়ের এক মুহূর্ত চলত না, তাঁরই অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে কোভিড রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিল পরিবার! সে দিনের কোভিড-যুদ্ধে অন্যের প্রাণ বাঁচিয়ে নজির গড়লেও বুধবার জীবন-যুদ্ধ ছাড়লেন সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত, অভিষিক্তা ব্রহ্ম নামে বছর উনিশের সেই তরুণী।

কন্যাহারা পিতা শুক্রবার বললেন, ‘‘মেয়ের জন্য বাড়িতে ছোটখাটো একটা হাসপাতালই তৈরি করতে হয়েছিল। ফাউলার বেড (হাসপাতালের বিশেষ শয্যা), বি-টাইপ অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর, অক্সিজেন মাস্ক, ট্র্যাকিয়োস্টমি টিউব, সাকশন মেশিন, সাকশন ক্যাথিটার ও নেবুলাইজ়ারের পাশাপাশি অনেক ওষুধপত্রও রয়েছে। সেগুলির কোনও কোনওটা দিয়ে করোনা রোগীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলাম। এখন কোনওটারই আর দরকার নেই। যাঁদের খুব প্রয়োজন, অথচ সামর্থ্য নেই, তাঁদের দিতে চাই। এমন অনেকে আছেন, চিকিৎসকেরা যাঁদের জবাব দিয়ে দিয়েছেন। অথচ, তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে‌ন। সেই লড়াইয়ে মেয়ের সরঞ্জামগুলো তাঁদের সাহায্য করবে।’’

জবাব দিয়ে দেওয়া হয়েছিল অভিষিক্তার ক্ষেত্রেও। ২০১৯ সালের নভেম্বরে তাঁকে ছাড়ার সময়েই হাসপাতাল বলেছিল, এ মেয়ে আর বড়জোর ছ’মাস। কিন্তু অভিষিক্তা বেঁচেছেন দু’বছরেরও বেশি। গত মে মাসে করোনার বাড়বাড়ন্তের সময়ে যখন অক্সিজেনের হাহাকার চলছে, তখন উল্টে তাঁর অক্সিজেন লাগেনি। বাবা অরিন্দম ব্রহ্ম বললেন, ‘‘কী করে মেয়ের অতটা উন্নতি হল, বলতে পারব না। তবে ওর অক্সিজেন স্যাচুরেশন সেই সময়ে ৮৮ শতাংশের আশপাশে ছিল। তাতেই ওর আর অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছিল না। তবে যে পরিস্থিতিই হোক, আমি আর ওর মা লড়াই চালিয়ে গিয়েছি।’’

কেমন লড়াই? অরিন্দমবাবু জানাচ্ছেন, নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্মেছিলেন অভিষিক্তা। জানা যায়, তিনি সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। হুইলচেয়ারেই আবদ্ধ হয়ে যায় অভিষিক্তার জীবন। সেই চলার পথেও বাদ সাধে একের পর এক খিঁচুনি (কনভালশন)। সেই সঙ্গে ধরা পড়ে শিরদাঁড়ার সমস্যাও (স্কলিয়োসিস)। শরীর ক্রমশ বাঁ দিকে বেঁকে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে খিঁচুনির পরে কোমায় চলে যান অভিষিক্তা। বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতাল তাঁকে কোমা থেকে বার করে আনে।

বাড়ি ফেরার ঠিক এক বছরের মাথায় ফের খিঁচুনি। এ বার জরুরি হয়ে পড়ে ভেন্টিলেশন। অরিন্দমবাবু বললেন, “বেসরকারি হাসপাতালে এক-এক দিনে ৩০ হাজার টাকা বিল হচ্ছিল। অনেক ঘুরে শেষে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের চিঠি নিয়ে মেয়েকে এসএসকেএমে ভর্তি করাই।” সেখানেই সিসিএম (ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন) বিভাগের পাঁচ নম্বর শয্যায় শুরু হয় অভিষিক্তার নতুন লড়াই। যদিও এর মধ্যে দু’চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন অভিষিক্তা। স্নায়ু এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, হাত-পা নাড়ানো তো দূর, গায়ে মশা-মাছি বসলেও তাড়াতে পারতেন না। গলার কাছে ছিদ্র করে ঢোকানো হয় অক্সিজেনের নল। এসএসকেএমে এই যুদ্ধেও জয়ী হন অভিষিক্তা। ১১ মাস পরে ভেন্টিলেশন থেকে বেরোন। যদিও চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, রোগীর প্রচুর চাপ। তাই সিসিইউ শয্যা ছাড়তে হবে অভিষিক্তাকে।

ফলে বাধ্য হয়ে বাড়িতেই ছোটখাটো হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেন অরিন্দমবাবুরা। ব্যবস্থা করতে হয় একাধিক সরঞ্জামের। সেগুলিই এখন দিয়ে দিতে চান তাঁরা। অরিন্দমবাবু বললেন, ‘‘সব ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু বেডসোর খুব বেড়ে গিয়েছিল। ভ্যাক ড্রেসিং করে পুঁজ টেনে বার করার জন্য একটা যন্ত্র ভাড়া নিতে হয়েছিল। তাতে যে সরঞ্জাম লাগে, মাসে তার খরচ প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। এক সময়ে মেয়েকেই সময় দিতে হবে ভেবে চাকরি ছেড়ে পার্ট-টাইম কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু এই খরচ তাতে পোষানো যাচ্ছিল না। তাই আবার চাকরি নিলাম।’’ গত সোমবার চাকরির কাজেই অন্য রাজ্যে গিয়েছিলেন অরিন্দমবাবু। মঙ্গলবার থেকেই অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে অভিষিক্তার। বুধবার সন্ধ্যায় ঠোঁটের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময়ে বাড়িতে ছিলেন না অভিষিক্তার মা-ও। স্যাচুরেশন, রক্তচাপ মেপে নিজের মতো করে চেষ্টাও করে অভিষিক্তার বছর দশেকের ভাই অরুণাদিত্য। এর পরে অভিষিক্তাকে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি।

অরিন্দমবাবু বললেন, ‘‘আমি ফিরতে ফিরতেই সব শেষ। মেয়ে আমার সাজতে ভালবাসত। লাল বেনারসি, পায়ে আলতা পরিয়ে ওকে আমরা বিদায় দিয়েছি। আর ওকে কথা দিয়েছি, ওর মতো লড়াই করছেন যাঁরা, তাঁদের পাশে দাঁড়াব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cerebral Palsy Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE