Advertisement
১৬ মে ২০২৪

স্মৃতিতে বিপর্যয়, তবু সরলেন না জীর্ণ বাড়ির বাসিন্দারা

সতী সাইনি নামে সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধা ৪২ নম্বর পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের বাসিন্দা। পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের সেই বাড়ি নিয়ে বেজায় শোরগোল হয়েছে পুর মহলে।

বিপজ্জনক: পাথুরিয়াঘাটায় ভেঙে পড়া বাড়ির অন্য অংশ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

বিপজ্জনক: পাথুরিয়াঘাটায় ভেঙে পড়া বাড়ির অন্য অংশ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৯ ০১:৪৭
Share: Save:

ঘরের মাঝামাঝি লাল রঙের তেল-চিটচিটে চৌকিতে শুয়ে তিনি। মাথায় বালিশ নেই। ঝড় আসছে শুনেছেন? হাতপাখাটা চৌকির উপরে পায়ের দিকে ছুড়ে দিয়ে বৃদ্ধা বললেন, ‘‘দু’দিন আগেই দুটো বৌ মারা গেল। এ বার বোধহয় আমার সময় হয়েছে।’’ বিরক্ত চোখে সিলিংয়ের দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘ছেলে অনেক রোজগার করে, কিন্তু এ বাড়ি ছাড়ে না।

অবস্থা দেখুন!’’

সতী সাইনি নামে সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধা ৪২ নম্বর পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের বাসিন্দা। পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের সেই বাড়ি নিয়ে বেজায় শোরগোল হয়েছে পুর মহলে। পুরনো এই বাড়ির পলেস্তারা খসে পড়ছে দেখে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক দিন স্থানীয় কাউন্সিলরের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বাড়ির বাসিন্দারা। কিন্তু অভিযোগ, কাউন্সিলর তেমন কিছুই করেননি। ‘দেখছি কী করা যায়’ বলে ফিরিয়ে দেন তিনি। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে সেই বাড়ির দুই বাসিন্দার মৃত্যু হয়।

শুক্রবার ফণীর চোখরাঙানি কলকাতা ছোঁয়ার আগে পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, এত কিছুর পরেও হুঁশ ফেরেনি

কারওই। বাড়ির ভেঙে পড়া অংশে থাকার পরিস্থিতি নেই। তবে বাড়ির অন্য অংশে আগের মতোই থাকতে শুরু করেছেন অনেকে। তাঁদেরই এক জন সতীদেবী। সতীদেবীর ঘরের ছাদের অবস্থা তাঁর ভঙ্গুর শরীরের থেকেও জীর্ণ। তবু এখানে থাকেন কেন? মাকে চুপ করিয়ে এর পরে সতীদেবীর পুত্র দীপক সাইনি বললেন, ‘‘এখানে ব্যবসা করি। যাব কোথায়?’’ ঝড়ের ভয় নেই? দীপকবাবুর উত্তর, ‘‘মরতে তো এক দিন হবেই। সত্যিই অন্য কোথাও উঠে যাওয়ার মতো টাকা নেই।’’ কাজের সূত্রে সম্প্রতি এই বাড়িতেই উঠে এসেছেন ওড়িশার বালেশ্বরের বাসিন্দা মহম্মদ ফারুক। জানালেন, বালেশ্বরে থাকা বাড়ির লোকের জন্য তিনি চিন্তিত। বললেন, ‘‘পুরীর তো খুব খারাপ অবস্থা। ওখানে এখন কী হচ্ছে খবর আছে? বাড়িতে সকাল থেকে ফোন করা যাচ্ছে না।’’ বিপদ তো তাঁরও ঘটতে পারে! ফারুক বললেন, ‘‘আমি সামলে নেব। এ বাড়ি ভাঙবে বলে মনে হয় না।’’

পুরসভা সূত্রের দাবি, বিপজ্জনক বাড়ির বাসিন্দাদের এই মনোভাবই সমস্যায় ফেলেছে তাঁদের। পুর-প্রশাসনের বারবার ঘোষণার পরেও পুরনো-বিপজ্জনক বাড়ি ছাড়েননি অনেকে। তালতলার ইন্ডিয়ান মিরর স্ট্রিটে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে পুরনো বাড়ি ভেঙে পড়ে এক কিশোরী-সহ মৃত্যু হয় দু’জনের। ভেঙে পড়া বাড়ির পাশের আর একটি বহুতলও হেলে পড়ে সেই সময়ে। এখন অবশ্য ওই হেলা বাড়িতেই বহাল তবিয়তে রয়েছেন বাসিন্দারা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘নিজের বাড়ি হেলে পড়লেও নিজেরই থাকে। বাড়ি ছাড়ব কেন?’’ একই কথা আমহার্স্ট স্ট্রিটের কালীদাস সিংহ লেনের বিপজ্জনক বাড়ির বাসিন্দা বিকি গুপ্তের। ‘বিপজ্জনক’ বোর্ড টাঙানো বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়েই বললেন, ‘‘কাউন্সিলরকে বলে

দিয়েছি, বাড়ি ছাড়তে পারব না। খুব বেশি হলে ঝড়ের সময়টা অন্য কোথাও থাকতে পারি।’’

মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলছেন, ‘‘বিপজ্জনক বাড়ির বাসিন্দাদের ধারণা, এক বার উঠে গেলে জায়গাটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। আশ্বস্ত করা হচ্ছে, যে যেখান থেকে উঠে যাচ্ছেন, তার রেকর্ড বরো অফিসে রাখা হচ্ছে। তবুও ভয় কাটানো যাচ্ছে না।’’ পুলিশ কেন বিপজ্জনক বাড়ি ফাঁকা করাচ্ছে না? কলকাতা পুলিশ জানাচ্ছে, পশ্চিম বন্দর-সহ কয়েকটি এলাকা থেকে প্রায় চার হাজার বাসিন্দাকে বিপজ্জনক বাড়ি থেকে সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এই কাজ যে সার্বিক ভাবে করা যায়নি, তা মানছেন

লালবাজারের কর্তারা।

গত মাসেই ভেঙে পড়ে আমহার্স্ট স্ট্রিটের বিপ্লবী পুলিন দাস স্ট্রিটের একটি বিপজ্জনক বাড়ির সিঁড়ি। দমকল, পুলিশ গিয়ে বাসিন্দাদের বার করে আনেন। কিন্তু এখনও সেই বাড়ি ছাড়েননি সকলে। বাড়ি সংস্কার না হলেও দোতলায় ওঠার নতুন সিঁড়ি তৈরি হচ্ছে সেখানে। সিঁড়ির ঠিক নীচের ঘরের বৃদ্ধা বাসিন্দা এ দিন বললেন, ‘‘ঝড়ে বাড়িটাই না থাকলে সিঁড়ি ধুয়ে জল খাব?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Old Building Disaster Cyclone Fani ফণী
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE