কবিতা রায়
সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ বিভোর হয়ে তিনি গাইছিলেন ‘নব আনন্দে জাগো’। চিরঘুমে যাওয়ার আগের রাতেও এতটাই স্বাভাবিক ছিল নিউ আলিপুরের নিহত বৃদ্ধ মলয় মুখোপাধ্যায়ের দৈনন্দিন ‘রুটিন’।
মলয়বাবুকে মৃত অবস্থায় প্রথম যিনি দেখেছিলেন, তিনি রাতের আয়া কবিতা রায়। মঙ্গলবার কবিতা জানান, সে দিন সন্ধেবেলা তিনি যখন কাজে আসেন, তখন মলয়বাবু সঙ্গীতচর্চায় মগ্ন ছিলেন। শুধু গান-বাজনার জন্যই একটি আলাদা ঘর রয়েছে ওই বাড়িতে। কবিতার কথায়, ‘‘কাকু (মলয়বাবু) তখন দেড়তলার গান-বাজনার ঘরে নিজের মনে গান করছিলেন। রাত আটটা নাগাদ দোতলায় এসে বলেন, আজ তোদের দাদা-বৌদি রাতে বাইরে থেকে খেয়ে আসবে।’’
সোমবার রাত থেকে দফায় দফায় কবিতাকে জেরা করেছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। এমনকী, তাঁর ছেলে তারকও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন।
মঙ্গলবার চেতলার বাড়িতে গিয়ে কবিতার হদিস পাওয়া গেল। অসুস্থ মা প্রীতিদেবীর দেখভালের জন্য ২০০০ সালে দৈনিক ৫০ টাকা মজুরিতে কবিতাকে নিয়োগ করেছিলেন মলয়বাবু। দিনে শ্যামলী ও রাতে কবিতা— দু’জন আয়া প্রীতিদেবীর দেখাশোনা করতেন। মাস দেড়েক আগে প্রীতিদেবী মারা গিয়েছেন। তার পরেও দু’জন আয়াকে বহাল রেখেছিলেন মলয়বাবু। কয়েক বছর আগে কবিতার দৈনিক পারিশ্রমিক বেড়ে হয় ২২০ টাকা।
প্রতি দিনই মলয়বাবু ও তাঁর ছেলে-বৌমার জন্য রান্না করতেন শ্যামলী। কবিতার কথায়, ‘‘কাকু একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে চলতেন। সব সময়ে হাতে ঘড়ি পরে থাকতেন। শুধু স্নানের সময়ে খুলতেন। আর ছিল টুপি ও ছড়ির শখ। নানা রঙের পাঁচটি টুপি ছিল ওঁর। বাড়ির বাইরে গেলেই মাথায় টুপি থাকত।’’
আরও পড়ুন:পেট্রোল নিয়ে হাইকোর্টে! কী করছিল পুলিশ
কী কী ঘটেছিল সে দিন?
কবিতা জানিয়েছেন, মলয়বাবুর শরীর ক’দিন ধরে বিশেষ ভাল যাচ্ছিল না। সর্দি-কাশিতে ভুগছিলেন তিনি। ঘড়ি ধরে রোজ সাড়ে আটটায় রাতের খাবার খেয়ে নিতেন মলয়বাবু। ওই দিনও সয়াবিন বড়ি দিয়ে আনাজ সেদ্ধ খেয়েছিলেন। শ্যামলী খাবার বেড়ে দেওয়ার পরে তিনি কবিতাকেও খেয়ে নিতে বলেছিলেন। এর পরে ঘণ্টাখানেক কবিতার সঙ্গে গল্পগুজব করার পরে শ্যামলী রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। সদর দরজায় ছিটকিনি দিয়ে দোতলায় চলে আসেন কবিতা। রাত ১১টা নাগাদ মলয়বাবুর পুত্র ও পুত্রবধূ বাড়ি ফেরেন। তার পরে সোজা নিজেদের ঘরে চলে যান। কবিতা জানান, বছর তিনেক আগে তাঁর কানে সংক্রমণ হয়েছিল। তাই দুই কানে এখনও রোজ ওষুধ দিতে হয়।
কবিতা বলেন, ‘‘দাদা-বৌদি ঘরে চলে যাওয়ার পরে আমি কাকুর পাশের ঘরে যাই। দুই কানে ওষুধ দেওয়ার পরে তুলো গুঁজে দিই।’’ কানের ওষুধ যাতে গড়িয়ে না পড়ে, সেই কারণেই তুলো।
ভোরে উঠে কী দেখলেন কবিতা?
কবিতার কথায়, ‘‘ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। কেন জানি না, সে দিন দু’চোখে ঝাপসা দেখছিলাম। মাথা কেমন ঝিমঝিম করছিল। কিছু ক্ষণ পরে দেখি, ঘরের জিনিসপত্র লন্ডভন্ড। আমার ব্যাগ থেকে ওষুধও মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে।’’
পাশেই মলয়বাবুর ঘর। সেখানে গিয়ে কবিতা দেখেন, আলো জ্বলছে। তাঁর কথায়, ‘‘দেখলাম, বিছানায় কাকুর শরীর পুরোটাই চাদর দিয়ে মোড়া। দু’বার ধাক্কা দিলাম। সাড়া পেলাম না। মাথার পাশ থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল। তখনই ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। ছুটে গেলাম দাদা-বৌদির কাছে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ওঁদের ঘুম থেকে তুলি।’’ দেখা যায়, সর্বত্রই জিনিসপত্র লন্ডভন্ড। লোহার সিঁড়ির কাছে কাঠের দরজার জাল কাটা।
পুলিশের তদন্তকারী অফিসারদের ধারণা, জাল কেটে যারা ঢুকেছিল, তারা ওই বাড়ির ভিতরের নকশা সম্পর্কে ভাল ভাবেই ওয়াকিবহাল। সে ক্ষেত্রে মলয়বাবুর পরিচিত কেউ এই খুনের পিছনে থাকতে পারে বলে সন্দেহ পুলিশের। তবে সেটা কে বা কারা, তা নিয়ে রহস্য এখনও গভীর আঁধারে।
কবিতা এ দিন জানিয়েছেন, ওই বাড়ির ছাদ খারাপ হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টি হলেই ঘরে জল পড়ে। শুভাশিসবাবু ও তাঁর স্ত্রীর ঘরে এক মিস্ত্রি মাসখানেক ধরে কাজ করছিলেন। এক ঠিকাদারও নিয়মিত সেই কাজের দেখভালের জন্য আসতেন। প্রায় প্রতি দিনই মলয়বাবুর সঙ্গে দেখা করতেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy