টাকা বদলের লাইনে। বৃহস্পতিবার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সামনে। — সুদীপ্ত ভৌমিক
ওষুধ কাজ করছে।
কড়া দাওয়াই পড়তেই অসুখ পালিয়েছে। তবে যেখানে ওষুধের দেখা মেলেনি, রোগ এখনও সেখানে বাসা বেঁধে আছে।
ওষুধের নাম কালি। কালি জুজুর ভয়ে বাতিল নোট বদলের লম্বা লাইন বৃহস্পতিবার ছোট হয়ে গিয়েছে।
ডালহৌসি, হাতিবাগান, সল্টলেক— শহরের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্কের সামনে ২৪ ঘণ্টা আগেও যে লম্বা লাইন ছিল, এ দিন তা অনেকটাই ছোট।
ব্যাঙ্ক কর্তারা জানাচ্ছেন, বাতিল ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বদল করতে গেলেই ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষ ডান হাতের আঙুলে কালি লাগিয়ে দেবেন। কেন্দ্রীয় সরকার এই নির্দেশ দেওয়ার পরেই লম্বা লাইন ম্যাজিকের মতো ছোট হয়ে গিয়েছে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, গ্রাহকের লাইনে কি ভূত রয়েছে? যে সব ব্যাঙ্কে কালি দেওয়া হচ্ছে না, সেখানে কিন্তু বিকেল পর্যন্ত লম্বা লাইন চোখে পড়ল। ঠিক যেন উলটপুরাণ। যেমন শ্যামবাজারের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে এ দিনও টাকা বদলের সময়ে কালি দেওয়া হচ্ছিল না। ব্যাঙ্ক কর্তারা জানালেন, হেড অফিস থেকে কালির ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই তা দেওয়া হচ্ছে না। ব্যাঙ্কের সামনে সাড়ে চারটে পর্যন্ত প্রায় দেড়শো
জনের লাইন।
ব্যাঙ্ক কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, প্রচুর যুবক টাকা বদলানোর কাজে নেমেছেন। যাঁরা এতদিন কালো টাকা (৫০০ এবং ১ হাজার নোট) ঘরে রেখেছিলেন, তাঁরা এখন এই যুবকদের দ্বারস্থ হয়েছেন। ৩০০-৪০০ টাকার বিনিময়ে এই যুবকের দল সারা দিন শহরের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের শাখায় ঘুরে, নিজেদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বেশ কয়েকবার ৪৫০০ টাকার পুরনো নোট বদলে নিচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে সল্টলেকের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে গেটের বাইরে যে যুবকদের ভিড় দেখা গেল, তাঁদের মুখ ম্যানেজার ও ব্যাঙ্ক কর্মীদের অচেনা। তাঁদেরই একজনকে একা পেয়ে— ‘‘আপনি কি সল্টলেকে থাকেন?’’ প্রশ্ন করতেই মাথা নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ। সল্টলেকের কোথায়? এ বার হেসে ফেললেন সেই যুবক। প্রথমে হাত তুলে দেখানোর চেষ্টা করলেন, ‘‘এই তো এ দিকে।’’ কোন ব্লক? কোন আবাসন? এ বার বিরক্তি সহকারে জানালেন, তিনি রাজাবাজার থেকে এসেছেন। সঙ্গে ৪৫০০ টাকার পুরনো নোট। একসঙ্গে দল বেঁধে জনা সাতেক যুবক। তাঁদের মধ্যে যিনি ‘মাতব্বর’, তিনি সবার হয়ে ফর্ম লিখে দিচ্ছিলেন। বাকিদের কথা বলতে বারণ করে দিলেন তিনি। ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সল্টলেক শাখার ম্যানেজার জানিয়েছেন, বুধবার বারাসত থেকে ২০ জন, রিপন স্ট্রিট থেকে ১৮ জন এসে এ ভাবে টাকা ভাঙিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। বুঝতে পারলেও চুপ করে থাকতে হচ্ছে। কেন্দ্রের নির্দেশ, আর ৪৫০০ টাকা নয়, শুক্রবার থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা বদলে নেওয়া যাবে। ম্যানেজারের কথায়, ‘‘এই টাকার অঙ্ক কমিয়ে দিলে এবং হাতে কালি লাগালে আরও চাপে পড়ে
যাবে কালোবাজারিরা।’’
নারকেলডাঙার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার জানিয়েছেন, ওই শাখায় মেদিনীপুর, বর্ধমান থেকেও যুবকের দল এসে টাকা ভাঙিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ম্যানেজার বলেন, ‘‘আমি চ্যালেঞ্জ করতেই সবাই বলছেন, তাঁরা নাকি আশপাশে কাজ করেন। তাই টাকা বদলাতে এসেছেন। সঙ্গে পরিচয়পত্রও রয়েছে। ফলে আমার আর কিছুই বলার থাকছে না।’’ তবে, বৃহস্পতিবার ওই ব্যাঙ্কে কালি লাগানো শুরু হতেই পাতলা হয়ে গিয়েছে ভিড়। এত দিন ২টি কাউন্টার থেকে টাকা বদলে দেওয়া হচ্ছিল। এ বার একটি কাউন্টার থেকে করা হচ্ছে।
ডালহৌসি চত্বরের কয়েকটি ব্যাঙ্কে কালি লাগানোর দাওয়াই আসতেই ভিড়ের অসুখ ভ্যানিশ হয়েছে। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের ডালহৌসি শাখায় বৃহস্পতিবার দিনভর টাকা বদলের লাইন বেশ ফাঁকা ছিল বলে জানাচ্ছেন ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষ। ওই শাখার এক ব্যাঙ্ক কর্তার কথায়, ‘‘কালির দাওয়াই হাজির হতেই লাইন ফাঁকা। সকাল থেকে উপচে পড়া ভিড় চোখে পড়েনি।’’ একই কথা বলছেন ওই চত্বরের আরেকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা ম্যানেজার। তিনিও জানান, সকাল থেকে থিকথিকে ভিড়টা এ দিন ছিল না।
বিমানবন্দর এলাকার একটি ব্যাঙ্কে টাকা বদলানোর কাউন্টার সকাল থেকে ফাঁকা। সেই ব্যাঙ্কের এক গ্রাহক জানাচ্ছেন, বুধবার পর্যন্ত বড়সড় লাইন ছিল। আজ ম্যাজিকের মতো ফাঁকা।
কসবার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের কথায়, ‘‘আরে! এ ভাবে একজন আমাদের এখানে ২০০৫ সালের আগের ছাপা (যেটা আগেই বাতিল হয়ে গিয়েছে) ৫০০ টাকার নোট জমা দিতে এসেছিলেন। চেপে ধরতেই বললেন, তাঁকে একজন দিয়েছেন জমা দেওয়ার জন্য।’’ ওই শাখাতেও বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত হাতে লাগানোর কালি এসে পৌঁছোয়নি।
তবে শুক্রবার থেকে প্রায় সমস্ত ব্যাঙ্কের সমস্ত শাখাতেই কালি লাগানো শুরু হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy