স্মৃতিমেদুর: আজও শশী-জেনিফারের স্মৃতি আঁকড়ে সাবেক ফেয়ারলন হোটেল। পাশে, হোটেলের কর্ত্রী ভায়োলেট স্মিথ। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
কার্পেটে মোড়া কাঠের সিঁড়ি, বাহারি রেলিং, লাল মেঝের দালান আর সবুজ খড়খড়ির জানলার জগৎটা যেন কেঁপে উঠেছিল বছর তিনেক আগে। সাবেক ব্রিটিশ শৈলীর কাঠামোটির আত্মা, ৯৭ বছরের এক নিস্পন্দ বৃদ্ধা যখন সেখান থেকে চিরবিদায় নিচ্ছেন।
আরবসাগর তীরের শহর থেকে তাঁর সুহৃদ এক বিখ্যাত প্রবীণের পাঠানো সাদা ফুলও এসে পৌঁছেছিল সদর স্ট্রিটের সেই বাড়িটিতে। রংবেরঙের মানুষের ফুলে গাঁথা কলকাতার বর্ণময় ইতিহাসের একটা অধ্যায়ও সে দিন ফুরিয়ে গেল। পাঁচ দিন আগে, গত সোমবার মুম্বইয়ে সেই প্রবীণের জীবনেও যবনিকাপাত। তাতেও কলকাতার বর্ণময় অতীত কিছুটা রিক্ত হল।
ফেয়ারলন হোটেলের কর্ত্রী, এ শহরের ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধা ভায়োলেট স্মিথকে ডাকা হতো ‘ডাচেস অব সদর স্ট্রিট’ বলে। আত্মীয়-বন্ধু, মেয়ে-জামাইরা এ শহর ছেড়ে গেলেও আমৃত্যু কলকাতার ধুলোধোঁয়া মেখে জীবনটা উপভোগ করেছেন আর্মেনিয়ান বৃদ্ধা।
আর অর্ধশতকেরও বেশি সময় তাঁর হোটেলের অতিথি তথা বৃহত্তর পরিবারের এক জন ছিলেন সদ্যপ্রয়াত শশী কপূর। পৃথ্বীরাজ কপূরের মেজ ছেলেটিও কলকাতার জাতক। তাঁর বিয়েও এ শহরে। সদর স্ট্রিটের ওই তল্লাটে জীবনের একটা মধুর অধ্যায়ের ঋণ শশী আমৃত্যু গভীর ভালবাসায় বয়ে বেড়িয়েছেন।
ফেয়ারলন হোটেলের ১৭ নম্বর ঘর আজও সেই গল্প বলে চলেছে। সেটা গত শতকের পাঁচের দশকের কথা। তাঁর থেকে বছর ছয়েকের বড় জেনিফার কেন্ডালের সঙ্গে একুশের সদ্য-যুবা শশীর বিয়েটা বাড়ির লোকের ভালভাবে হজম হয়নি। নবদম্পতি শশী-জেনিফারের দাম্পত্যের ইনিংস অতএব শুরু হল সেই ১৭ নম্বর ঘরেই।
বোধহয় এক মাস সেখানে ছিলেন নবদম্পতি। তবে প্রেমের চিত্রনাট্যের সুতোর বুনন আর একটু পুরনো। সাবেক গ্লোব সিনেমায় তখন ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দল নিয়ে জমিয়ে শেক্সপিয়রের নাটক করছেন জেনিফারের মা-বাবা লরা ও জেফ্রি। ‘দ্য টেমপেস্ট’-এর মিরান্ডাকে দেখে প্রেমে হাবুডুবু শশী। লরা-জেফ্রিরাও মাসের পর মাস থাকতেন ফেয়ারলনেই।
বিয়ে, মধুচন্দ্রিমার পরে শশী-জেনিফার যখনই কলকাতায় এসেছেন, পাঁচতারা বিলাসের টান উপেক্ষা করে শ্রীমতি স্মিথের যত্নের মায়াতেই আবদ্ধ। জেনিফার চিরবিদায় নিয়েছেন তিন দশক আগেই। তার পরও শশী কলকাতায় এলেই, তাঁর ঠিকানা পুরনো হোটেলের সেই ঘরেই।
শশী-জেনিফারের প্রেমের মতোই ভায়োলেট স্মিথের জীবনটাও প্রেমেরই কাহিনি। কলকাতার সঙ্গে প্রেম। বিশ শতকের গোড়ায় আর্মেনিয়ায় তুর্কিদের গণহত্যার সময়ে খাইবার পাস পেরিয়ে কোনওমতে ঢাকায় পালিয়ে আসেন ভায়োলেটের মা-বাবা। সেখানে কিছু দিন পাটের কারবারের পর খুচরো পয়সা-ভরা কেরোসিনের টিন নিয়ে গন্তব্য কলকাতা। সদর স্ট্রিটের হোটেল ব্যবসার সেই সূচনা। ভায়োলেটের সঙ্গে খাঁটি ইংরেজ সাহেব এডমন্ড ফ্রেডরিক স্মিথের বিয়ে হলেও বিলেতে থাকা পোষায়নি তাঁর। ’৬০-এর দশকে বরকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে হোটেলের ভার নেন তিনি। এডমন্ডও বছর ১২ আগে কলকাতায় মারা গিয়েছেন। কিন্তু নিজের শহর ছাড়েননি ভায়োলেট। হোটেলের ম্যানেজার রবীন্দ্রনাথ পালের কাছে শোনা যাবে, কী ভাবে গাড়িতে সকাল-বিকেল ধুলো-মাখা কলকাতার বুকেই বেড়াতে ভালবাসতেন বুড়ি মেমসাহেব।
এ সব পুরনো চরিত্রের মতো সদর স্ট্রিটের হোটেলও পাল্টেছে বিস্তর। তখন সাহেব পর্যটকেরা কলকাতায় এসেও এক ধরনের আয়েশি কিন্তু অভিজাত ব্রিটিশ জীবনযাপন পছন্দ করতেন। আশির দশকে ৫০০-৬০০ টাকায় তিন বেলার থাকা-খাওয়া মিলত হোটেলে। অতিথিদের ডাকতে দফায় দফায় খাবার ঘণ্টাও পড়ত। এ যুগে সে-সব না-পসন্দ সাহেবদেরও। স্টেক রোস্টের বদলে মেনুতে ভারতীয় বা চিনে খাবারেরই কদর।
হোটেলের সাজসজ্জা তবু ফেলে-আসা সময়কে বহন করছে। ১৭ নম্বর ঘরের বাইরে লেখা ‘দ্য শশী কপূর রুম’। ভায়োলেট স্মিথ, শশী কপূরদের গল্প আসলে শহরের সাতরঙা নাগরিক যাপনের গল্প। সাবেক দালান-সিঁড়ি-জানলায় যার আভাস মিলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy