সরাতে গিয়ে ভেঙে গিয়েছে এই মূর্তিটিই।
ভাবনা এবং রূপায়ণের ফাঁকফোকরে কলকাতাকে যে নিত্য ভুগতে হচ্ছে, তা ফের মালুম হল। সম্প্রতি পরমা আইল্যান্ডে একটি মূর্তি সরানোকে কেন্দ্র করে রাজ্য সরকারের এই হঠকারী আচরণের ছবিটা প্রকট হয়েছে।
যেমন এ যাত্রা, কোনও রকম পরিকল্পনা ছাড়া সরকারি খেয়ালে মূর্তি সরাতে গিয়ে তা ভেঙেই ফেলেছেন কেএমডিএ-কর্তৃপক্ষ। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে অবশ্য লজ্জিত রাজ্য সরকার। এ বার খোদ নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম (ববি) এই ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন।
শাসকদের মর্জিমাফিক শহরে বসানো বিভিন্ন মূর্তি বা ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা অবশ্য এ শহরে নতুন কিছু নয়। যেমন, বছর দশেক আগে বাম আমলে পার্ক স্ট্রিট-ক্যামাক স্ট্রিটের মোড় থেকে শিল্পী তাপস সরকারের সৃষ্টি একটি ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলে তৎকালীন তৃণমূল পুর-বোর্ড। সে-বার মূর্তিটি না ভাঙলেও শিল্পীদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে ফেলা হয়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে মৌলালি যুবকেন্দ্রের গায়ে বিজন চৌধুরীর সৃষ্ট ম্যুরাল বা দেওয়ালচিত্রটি নষ্ট করে ফেলা হয়। তার বদলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ শিল্পী শুভাপ্রসন্নের কাজ বসে সেখানে। শহরের মূর্তি বা ভাস্কর্য নিয়ে সরকারি খেয়ালের সাম্প্রতিকতম বলি প্রয়াত ভাস্কর শানু লাহিড়ীর সৃষ্টি একটি নারীমূর্তি। ‘পরমা’ নামের ৪০ ফুটের ভাস্কর্যটির সৌজন্যেই মুখে মুখে ই এম বাইপাসের মোড়টির নাম পরমা আইল্যান্ড হয়ে গিয়েছে।
কী ভাবে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হল ওই মূর্তির? সরকারি সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছা ও পরিকল্পনায় ব্র্যান্ড বিশ্ব বাংলার প্রতীক ‘ব’কে বাইপাসের ওই মোড়ে প্রতিষ্ঠা করার ভাবনা রয়েছে। শুক্রবার মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “বিশ্ব বাংলার ব-সুদ্ধ একটা বড় গ্লোব ওখানে বসবে। তাই আগের মূর্তিটি আমরা সল্টলেকের একটি পার্কে সরাতে চেয়েছিলাম।” কিন্তু কেন ভাঙা হল মূর্তি? ফিরহাদের কথায়, “সাধারণত এমন মূর্তির ভিতরে লোহার রডের চাড় দেওয়া থাকে। কিন্তু এই মূর্তিটি অন্য ভাবে গড়া ছিল। যাঁরা নামাচ্ছিলেন, তাঁরা সেটা বুঝতে পারেননি। তখনই ভুল করে মূর্তিটি ভেঙে যায়। এর জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।”
কিন্তু যথেষ্ট সাবধানতা বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়াই কেন সরানো হচ্ছিল ওই মূর্তি? নিজেদের খেয়ালে মূর্তি সরানোর সিদ্ধান্তই বা কী ভাবে নিল রাজ্য সরকার? প্রশাসনের কাছে এর সদুত্তর মেলেনি। বিষয়টিতে আহত ভাস্কর নিরঞ্জন প্রধান। তাঁর ক্ষোভ, “বছর ১০-১২ ধরে এমন নির্মম ভাবেই মূর্তি-ম্যুরাল সরানো হচ্ছে। এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সমাজে কুলক্ষণ।” তিনি মনে করাচ্ছেন, অনেক আগে পাতাল রেলের কাজে পার্ক স্ট্রিটের গাঁধী-মূর্তি কিন্তু যত্ন করেই মেয়ো রোডে সরানো হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে তৃণমূল সাংসদ তথা চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী। তিনি বলেন, “আমি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। তাই এ নিয়ে কিছু বলব না। আনন্দবাজারকেও কিছু বলতে চাই না। তবে যেখানে যা বলার, সেটা বলেছি।” কয়েকটি গণসংগঠনের ব্যানারে সাংস্কৃতিক কর্মীরাও প্রতিবাদে পথে নেমেছেন।
সাম্প্রতিক অতীতে কলকাতার দিকচিহ্নগুলো চেহারায়-চরিত্রে পাল্টে যাওয়ার ছবিটা সেলুলয়েডে ধরেছেন ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-খ্যাত অনীক দত্ত। তাঁর কথায়, “সভ্য দেশে যোগ্য লোকেরা স্বাধীন ভাবে শহর সাজানোর সিদ্ধান্ত নেন। রাজনীতির নেতা-নেত্রীরা বিষয়টায় নাক গলান না। পরমার মূর্তিটা হঠাৎ সরাতে গিয়ে যা ঘটল, তাতে অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy