Advertisement
১৯ মে ২০২৪

কলকাতার মন ছিল হিলারির দিকেই

থমথমে হতভম্ব ‘গাধা’র ভিড়ে ‘হাতি’রা তখন ঢাকাই পড়ে গিয়েছে। তবু ফ্লোরিডার ফল ঘোষণা হতেই স্কুলের পোশাক পরা ছিপছিপে সদ্য তরুণ দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে উঠল। বুধবার বেলা ১০টা। কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের লিংকন রুমে তার আগে ট্রাম্প সাহেবের সমর্থকদের বড় একটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

লিংকন রুমে বিমর্ষ ছাত্রীরা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

লিংকন রুমে বিমর্ষ ছাত্রীরা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০২:১১
Share: Save:

থমথমে হতভম্ব ‘গাধা’র ভিড়ে ‘হাতি’রা তখন ঢাকাই পড়ে গিয়েছে। তবু ফ্লোরিডার ফল ঘোষণা হতেই স্কুলের পোশাক পরা ছিপছিপে সদ্য তরুণ দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে উঠল।

বুধবার বেলা ১০টা। কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের লিংকন রুমে তার আগে ট্রাম্প সাহেবের সমর্থকদের বড় একটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রাতরাশের আসরে যাঁরা জড়ো হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই পড়ুয়া। ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষার জন্য মার্কিন মুলুকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এই দলটা তো বটেই, আমেরিকার ভোটরঙ্গ দেখতে হাজির জনতার চোদ্দো আনাই ডেমোক্র্যাট শিবিরের ‘গাধা’ আঁকা ব্যাজটাই বেছে নিয়েছিলেন। শিল্পপতি সঞ্জয় বুধিয়ার মতো কেউ কেউ শুধু নিজের পছন্দ কবুল করেননি।

যে গুটিকয়েক জনগণ, ‘হাতি’র ব্যাজ জামায় এঁটেছিলেন, ওই তরুণ তাঁদের একজন। লক্ষীপত সিংহানিয়া স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণি অরবিন্দ কুমার। দাবি করলেন, ‘‘ট্রাম্পকে যতটা ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে, আদতে উনি তেমন নন। রাজনীতির শর্ত মেনে ভোট প্রচারের চেয়ে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনেক নরম হবেন। আর ভারতীয়দের তো মোটেই তেমন চিন্তার নেই।’’

জিডি বিড়লা সেন্টার ফর এডুকেশনের এগারো ক্লাস— সুলগ্না দাশগুপ্ত, সৃষ্টি চট্টোপাধ্যায় বা বারো ক্লাসের ঈশা লাহিড়ীরা ঝাঁঝিয়ে উঠে প্রতিবাদ করলেন। পরে ট্রাম্প বিজয়-সম্ভাষণে ‘স্মার্ট, বুদ্ধিমান ভারতীয় ছাত্র’দের প্রশংসা করলেও দেখা গেল ঠিক নিশ্চিন্ত নন ওঁরা। সুলগ্নার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে, সৃষ্টি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য আর ঈশা নিউ ইয়র্কে জৈবপ্রযুক্তির পাঠ নিতে আগ্রহী। সুলগ্না বললেন, ‘‘ট্রাম্প এখন যাই বলুন, উনি আমেরিকানদের জন্য আমেরিকা, বলেই এত ভোট পেয়েছেন! ভারতীয় পড়ুয়াদের এখন দু’বার ভাবতে হবে।’’ ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারির ন্যূনতম খরচায় কলেজ শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার পক্ষে অনুকূল নীতির প্রতিশ্রুতি বেশি মনে ধরেছিল ওই তরুণীদের। ফ্লোরিডার পরে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের স্টেটগুলো— মিশিগান, পেনসিলভ্যানিয়া— হিলারির রাশ আলগা হচ্ছে দেখে মডার্ন হাই স্কুলের এক ছাত্রী কেঁদেই ফেললেন।

অরবিন্দ কুমার বা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্সের প্রথম বর্ষ অভীক সরকার, প্রাঞ্জল মণ্ডলেরা অবশ্য এখন জাতীয় স্বার্থ নিয়ে খানিকটা উদ্বেল। তাঁদের এক কথা, ‘‘ট্রাম্প ও মোদীর বিদেশ নীতি খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে। পাকিস্তান বা চিনের সঙ্গে টক্করেও ট্রাম্প আমাদের পাশে থাকবেন আশা করাই যায়।’’

ভোট প্রচারে ভাঙা হিন্দিতে নরেন্দ্র মোদীর স্লোগান ধার করে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আবি কি বাড়, ট্রাম্প সোরকার!’ কিন্তু আমেরিকান সেন্টারে জনতার মেজাজ দেখে কলকাতার মার্কিন কনসাল-জেনারেল ক্রেগ হল কবুল করলেন, ‘‘এখানে তো দেখছি, শ্রীমতি ক্লিন্টনের দিকেই পাল্লা ঝুঁকে আছে।’’ প্রাক্তন বিদেশসচিব হিলারি যে এই শহরের জল-হাওয়া মেখে গিয়েছিলেন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখেছিলেন বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দরবারে নকুড়ের সন্দেশে আপ্যায়িত হয়েছিলেন, সেটাও বুঝি মনে রেখেছিল কলকাতা। হিলারির সেই সফরে তাঁর সঙ্গে বৈঠকে মুখোমুখি হয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ত্রী উর্মি বসু। এ দিন জায়ান্ট স্ক্রিনে ভোটের ফলের ধারাবিবরণীর ফাঁকে বলছিলেন, ‘‘উনি (হিলারি) তখন বলেছিলেন, নারী পাচার রোখার কাজে উনিই হবেন আমাদের সব থেকে বড় চিয়ারলিডার! কিন্তু এখন মার্কিন সাহায্যের হাত কতটা উপুড় হবে, তা নিয়ে একটু খচখচ করছে।’’ ট্রাম্পের জাতিবিদ্বেষী, সমকামী-বিদ্বেষী বা নারীবিদ্বেষী ভাবমূর্তিও তাঁকে তাড়া করছে।

তাতে অবশ্য ভোটের ফলে ফারাক হয়নি। তবে হিলারির রাশ যে নানা স্তরে খানিক ঢিলে-ও হয়েছে, সেটাও এ দিন মালুম হয়েছে। সেক্টর ফাইভের একটি সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে আসা ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থার তিন কর্তা, টেক্সাসের তিন মার্কিন সাহেবের মধ্যে দু’জন নিজেদের ‘হিলারি-বিরোধী’ বলে পরিচয় দিলেন। কিন্তু সরাসরি ট্রাম্প-সমর্থক বলতে চাইলেন না। কেন? মার্কেটিং এজেন্সির পেশাদার, ভারতে বেড়াতে আসা ক্যালিফোর্নিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ যুবা বেনো বেনেটস ব্যাখ্যা করলেন, ট্রাম্পকে নিয়ে আসলে নানা কিসিমের অজানা আশঙ্কা কাজ করছে। শ্বেতাঙ্গ, ধনী ও পুরুষ ভোটার ছাড়া বাকিরা বেশির ভাগই কমবেশি সে ভয়ের শিকার! তা হলে এত ভোট পেয়ে জিতলেন কী করে ট্রাম্প? বেনো হাসলেন, ‘‘হিলারির মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিকের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণাও কাজ করেছে আম ভোটারদের মধ্যে। ট্রাম্প প্রচারে বিতর্ক ছড়িয়েছেন। তবু ওঁর অপেক্ষাকৃত অজানা দিকগুলো অনেক ভোটারকে চুপচাপ তাঁর দিকে টেনেছে।’’

পেশায় অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এক প্রবীণ থেমে থেমে বললেন, ‘‘যে দাঁত খাওয়ার তা কিন্তু দেখানোর নয়।’’ তার পরে চোখ টিপলেন, ‘‘জয় শ্রী ট্রাম্প!’’ তত ক্ষণে ফাঁকা হয়ে আসা হলঘরের পর্দায় ‘ভিকট্রি স্পিচ’ দিতে মঞ্চে উঠছেন প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hillary clinton Donald trump Presidential election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE