স্নেহ: বাবা অনুপ সরকারের সঙ্গেই এখন দিন কাটছে খুদে জ্যোতিষ্কার। (ইনসেটে) রুনু বিশ্বাস। নিজস্ব চিত্র
মায়ের দুধ পায় না সে। তাই প্যাকেটবন্দি গুঁড়ো দুধই তার ভরসা। খেলনা, দুধের বোতল, প্রবল ঠান্ডায় রুম হিটারের পাশাপাশি তাকে নিয়ে পরিবারের বাড়তি সতর্কতা সর্ব ক্ষণের মশারি। কারণ, তাকে মানুষ করতে গিয়ে দাদু-দিদিমার অহরহ মনে পড়ে, ১১ দিনের শিশু জ্যোতিষ্কাকে রেখে তাঁদের মেয়ের ডেঙ্গিতে মৃত্যুর কথা।
গত কয়েক বছরের মতো ২০১৯ সালেও প্রশাসনের কালঘাম ছুটিয়েছে ডেঙ্গি-মৃত্যু। বর্ষা পেরিয়ে ডিসেম্বরের শুরুতেও প্রাণ কেড়েছে ডেঙ্গি। শহরে সব থেকে শোরগোল পড়ে কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল রুনু বিশ্বাসের (২৮) ডেঙ্গিতে মৃত্যুর ঘটনায়। গত ২৫ অক্টোবর জ্বর নিয়ে ভিআইপি রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা রুনুকে। সেখানেই ২৬ অক্টোবর মেয়ের জন্ম দেন তিনি। পরিবার তার নাম রাখে জ্যোতিষ্কা।
অস্ত্রোপচার করে সন্তানের জন্ম দেওয়ার দু’দিনের মাথায় বাগুইআটি অশ্বিনীনগরের বাসিন্দা রুনুর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। প্লেটলেট ৬৫ হাজারে নেমে যায়। ২৯ অক্টোবর রুনুকে বাইপাসের ধারের এক বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে ৬ নভেম্বর মৃত্যু হয় তাঁর।
মায়ের মৃত্যুর পরে ১১ দিনের মেয়ের দায়িত্ব নেন তার মেজো মাসি রিঙ্কু আগরওয়াল। সেখানে রিঙ্কুদেবীর এক পুত্র এবং এক কন্যার সঙ্গে থাকছিল শিশুটি। মায়ের বুকের দুধ না পেলেও প্রথমটায় কোনও সমস্যা হয়নি জ্যোতিষ্কার। রিঙ্কুদেবীদের আবাসনের দোতলার ফ্ল্যাটের বাসিন্দা, সদ্য মা হওয়া এক মহিলাই দায়িত্ব নিয়েছিলেন শিশুকন্যাটির। নিজের সন্তানের মতোই তাকেও পান করাচ্ছিলেন বুকের দুধ। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাসির বাড়ি থেকে মাসখানেক আগে জ্যোতিষ্কাকে অশ্বিনীনগরের বাড়িতে নিয়ে যান তার বাবা অনুপ সরকার। এখন সেখানেই অনুপ এবং রুনুর পরিবারের সকলে মিলে দেখাশোনা করছেন শিশুটিকে।
সেখানে কেমন কাটছে তার সময়? বর্ষশেষের দিনেও নাতনিকে নিয়ে প্রবল ব্যস্ত জ্যোতিষ্কার দাদু-দিদার কথা বলার ফুরসত নেই। তাঁর মধ্যেই দাদু রাজকুমারবাবু কোনও মতে জানান, দু’ঘণ্টাও টানা ঘুমোয় না নাতনি। মাঝেমধ্যেই কেঁদে ওঠে। তখন গুঁড়ো দুধ গুলে খাওয়াতে হয়। কোলে নিয়ে পায়চারি না করলে অনেক সময়েই কান্না থামে না। দিদা কল্পনাদেবী আবার জানালেন, ঝুনঝুনি ওর খুব পছন্দের। ওটা দেখালে একটু শান্ত হয়। তাঁর কথায়, ‘‘ও আবার মশারির মধ্যে বেশি ক্ষণ থাকতে চায় না। বোধহয় গুমোট লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই আমাদের। ডেঙ্গি আমার মেয়েটাকে কেড়ে নিয়েছে, সেটা ভুলি কী করে? যতই বায়না করুক, বেশি ক্ষণ ওকে মশারির বাইরে রাখি না আমরা।’’ আর রয়েছেন মৃতা রুনুর দিদা সত্তরোর্ধ্ব কমলা রায়। মেয়ের ঘরের নাতনিকে অকালে হারালেও তাঁর সন্তানকে আঁকড়েই এখন নতুন জীবন পেয়েছেন তিনি। বর্ষবরণের আগে এই শিশুকন্যাই যেন তাঁর কাছে মস্ত উপহার।
স্ত্রীর মৃত্যুর প্রায় দু’মাস পরেও মেয়েকে রেখে কাজে যোগ দিতে পারেননি পেশায় কলকাতা পুলিশের কর্মী অনুপ। নতুন বছরের পরিকল্পনা কী? রাতে মেয়ের ঘুম ভাঙলে তার সঙ্গে ছবি তুলবেন। আর? কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, ‘‘এখন আর আগে থেকে পরিকল্পনা করি না। লাভ কী?’’
সদ্য চলে যাওয়া বছর যে তাঁর জন্য রেখে গিয়েছে চরম অভিজ্ঞতা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy