কলকাতার সব বিধায়ক এখন তাদের। শহরের দুই লোকসভা কেন্দ্রও তাদের দখলে। এ বার আরও দাপট দেখিয়ে তৃণমূলই কলকাতা পুরসভার দখল রাখতে চলেছে! আসন্ন পুরভোটের আগে এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেনের যৌথ জনমত সমীক্ষা অন্তত তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বস্তুত, সমীক্ষা বলছে গত বছরের লোকসভা নির্বাচনের চেয়েও কলকাতা পুরভোটে ভাল ফল করতে চলেছে তৃণমূল। শহরের ১৪৪টি ওয়ার্ডে শাসক দলের ভোট প্রায় ৬% বাড়তে পারে। গত বছর লোকসভা ভোটে যেখানে তারা ৩৭.০৭% ভোট পেয়ে ৯৯টি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল, পুরভোটে সেখানে তারা ৪৩% ভোট পেয়ে ১০১টি ওয়ার্ডে জয়ী হতে পারে বলে সমীক্ষায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সীমানা পুনর্বিন্যাসের ফলে কলকাতা পুরসভার মোট ওয়ার্ডসংখ্যা এ বার অবশ্য ১৪১ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪৪। কিন্তু এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেনের সমীক্ষা হয়েছে ১৪১টির ভিত্তিতেই।
এটা ঠিক যে, জনমত সমীক্ষায় সব সময় বাস্তবের প্রতিফলন ঘটে না। কিন্তু সমীক্ষার ফল ভোটবাক্সে মিলে যাওয়ার উদাহরণও কম নয়। তা ছাড়া, সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভোটারদের ভাবনার আভাস পেতেও এই ধরনের সমীক্ষার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। সমীক্ষক সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, কলকাতার ৭০টি ওয়ার্ডে সাড়ে ৮ হাজারেরও বেশি মানুষের মতামত নিয়ে এ বারের সমীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা সমীক্ষা করা হয়েছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চের মধ্যে। তখনও অবশ্য কোনও দলেরই প্রার্থী ঘোষণা হয়নি।
এই সমীক্ষা নিয়ে বিরোধীরা অবশ্য কিছু প্রশ্ন তুলছে। তাদের বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাজকর্মে মূলত শহরের মানুষের মধ্যেই ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে বেশি। দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি এবং অপশাসনের নানা অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে যে ভাবে প্রতিনিয়িত উঠে আসছে, তার প্রভাবও শহুরে অঞ্চলেই স্বাভাবিক ভাবে বেশি। তার পরেও কলকাতা শহরে কী ভাবে তৃণমূলের ভোট বাড়বে?
তবে একই সঙ্গে সব দলের নেতারা এটাও স্বীকার করছেন যে, লোকসভা, বিধানসভা এবং পুরসভা ভোটে মানুষ প্রার্থীদের বিচার করেন আলাদা আলাদা মাপকাঠিতে। পুরসভা নির্বাচনে অনেক সময়েই বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচার্য হয় না। সেখানে মানুষ রায় দেন স্থানীয় বিষয়ের ভিত্তিতে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পরিষেবার কাজ কোনও কাউন্সিলর কেমন করেছেন, পাড়ায় পাড়ায় কার জনসংযোগ কেমন এ সব প্রশ্নের উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচারের অনেক হাতিয়ার আছে মানেই পুরভোটের ফল তাদের বিরুদ্ধে যাবে, এমন মনে করার কারণ নেই। বিরোধী সিপিএমের এক নেতার কথায়, “লক্ষ্য করলে দেখা যাবে,বিরোধীদের হাতে-থাকা কিছু ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের পুরভোটের ঠিক আগে তৃণমূল ভাঙিয়ে আনছে। এ সব তো আসন বাড়ানোর জন্যই!”
যৌথ সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্য বিশ্লেষণ করলে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট। শহরে বিজেপি-হাওয়ার তীব্রতা কমছে! গত লোকসভা ভোটে বিজেপি কলকাতায় ভোট পেয়েছিল ২৩.৬৫%। শহরের দু’টি লোকসভা কেন্দ্রেই তারা ছিল দ্বিতীয় স্থানে।
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরে তারা সামান্য ভোটে এগিয়েওছিল। উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো বিধানসভা এলাকাতেও তারা এগিয়ে ছিল। কিন্তু সমীক্ষা বলছে, পুরভোটে বিজেপির ভোট কমে ১৫%-এ দাঁড়াতে পারে। লোকসভার নিরিখে যেখানে বিজেপি এগিয়েছিল ২৬টি ওয়ার্ডে, সেখানে পুরভোটে তারা ৮টি দখল করতে পারে বলে সমীক্ষার ইঙ্গিত!
রাজ্য বিজেপি-র অন্যতম সাধারণ সম্পাদক এবং দলের একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য দাবি করছেন, “এই সমীক্ষার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্কই নেই! লোকসভা ভোটের চেয়ে তৃণমূলের ফল পুরসভায় খারাপ হতে বাধ্য। বিজেপি এ বার চমকে দেওয়ার মতো ফল করবে!” যদিও বিজেপির অনেক নেতাই ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন, লোকসভা নির্বাচনে তাঁরা লড়াই করেছিলেন মোদী-হাওয়ায়। সেই হাওয়া চিরকাল থাকার কথা নয়। পুরভোটে সাফল্য পেতে গেলে দরকার ছিল সংগঠন এবং স্থানীয় প্রশ্নে আন্দোলন গড়ে তোলা। গত ৯ মাসে সেই কাজ যে বিশেষ নজর পায়নি, মেনে নিচ্ছেন বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ। দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “প্রস্তুতি যেমন ভাবে হওয়া উচিত ছিল, তেমন ভাবে হয়নি। এখন আর একটাই রাস্তা খোলা আছে। প্রার্থী বাছাইটা যথাসম্ভব নিখুঁত করা।”
পাঁচ বছর আগে কলকাতা পুরসভায় তৃণমূল জিতেছিল ৯৫টি আসন। সেখান থেকে এ বার সমীক্ষা অনুযায়ী আসন বেড়ে হচ্ছে ১০১। সেই ২০১০ সালের পুরভোটে প্রাপ্ত ৪৭.৬% থেকে তৃণমূলের ভোট এ বার কমে ৪৩%-এ আসতে পারে বলে সমীক্ষা ইঙ্গিত দিচ্ছে ঠিকই।
কিন্তু ২০১০-র পরে রাজ্য ও দেশের রাজনীতিতে বহু পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। তাই পাঁচ বছর আগের পরিসংখ্যানের সঙ্গে তুলনা বিশেষ বাস্তবসম্মত নয়। বরং, তুলনা টানা যেতে পারে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে এবং সেই তুলনা তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে শ্লাঘার বিষয়ই বটে! তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলছেন, “বারবার বলছি, কুৎসা বা অপপ্রচার যা-ই চলুক, মানুষ আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই। পুরভোটে বিপুল আসন পেয়ে জিতব। বিজেপি-র বেলুন আরও চুপসে যাবে!”
সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, বামফ্রন্টের আসন গত বারের ৩২ থেকে এ বার কমে হচ্ছে ২৫। কিন্তু লোকসভা ভোটের নিরিখে দেখলে বামেদের স্বস্তিরও কারণ আছে। লোকসভা নির্বাচনে শহরের দু’টি কেন্দ্রেই তৃতীয় হয়ে বামেরা পেয়েছিল ২৪.৯৫% ভোট। সেখানে সমীক্ষা বলছে, পুরভোটে রক্তক্ষরণের ধাক্কা সামলে বামেদের ভোট সামান্য হলেও বাড়ছে। তারা পেতে পারে ২৮% ভোট। ওয়ার্ডভিত্তিক হিসাবে গত বছর লোকসভার ফলের নিরিখে বামেরা এগিয়েছিল ১১টি আসনে। সেখানে আসন্ন পুরভোটে তাদের আসন বেড়ে হতে পারে ২৫। কার্যক্ষেত্রে এমনটাই ঘটলে বিপর্যস্ত বামেরা আগামী বছর বিধানসভা ভোটের আগে নতুন উদ্যমে লড়াই করার রসদ পাবে।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম অবশ্য বলছেন, “পুরভোট নিয়ে এখনই শেষ কথা বলার সময় আসেনি। নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে সমীকরণ পাল্টায়। কলকাতার পুর নির্বাচন নিয়েও আরও অপেক্ষা করতে হবে। আর ভোটপ্রাপ্তির হারের সঙ্গে আসনসংখ্যার অনুপাতের অঙ্ক বরাবরই বেশ জটিল!” তবে একই সঙ্গে সেলিমের আরও যুক্তি, “বিজেপি-র হাওয়া যখন তীব্র হচ্ছিল, তখন সংখ্যালঘুরা এ রাজ্যে নিরাপত্তার আশায় তৃণমূলের দিকে ঝুঁকছিলেন। তাতে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান বাড়ছিল। যেটা সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে হয়েছে। কিন্তু বিজেপির হাওয়া কমে এলে সংখ্যালঘুরা নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবেন। সব সংখ্যালঘু ভোট শাসক দলের দিকেই যাবে, এমনটা না-ও হতে পারে।”
বাম নেতৃত্বের আরও বিশ্লেষণ,ক্লাবের জন্য অকাতরে টাকা দেওয়া-সহ আরও কিছু খয়রাতির সিদ্ধান্ত পুর-লড়াইয়ে তৃণমূলকে কিছুটাএগিয়ে রাখছেই।
জনমত সমীক্ষার চমকপ্রদ তথ্য, ভাঙনে বিধ্বস্ত কংগ্রেস এ বার ৭টি ওয়ার্ড জিততে পারে! গত বছরের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় তাদের ভোট কমছে মাত্র ১.৩৯%! সুমন সিংহ, মালা রায়ের মতো কাউন্সিলরেরা দল ছেড়ে দেওয়ার পরে কলকাতায় কংগ্রেস শূন্য হয়ে যেতে পারে বলে যেখানে অনেকের ধারণা, সেখানে এই সমীক্ষার ফল চমকে দেওয়ার মতোই। কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার মতে, “পরিবারতন্ত্রে দীক্ষিত তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ অংশের সমর্থন কংগ্রেসের দিকে আসবে, আমরা আশা করছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy