জঞ্জালের স্তূপ থেকে বেরোচ্ছে ধোঁয়া। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
দমদম ও বেলঘরিয়ার মাঝে ট্রেনযাত্রীরা এখন জানলা খুলতে চান না। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা রীতিমতো দম বন্ধ করে থাকেন!
সন্ধ্যা গড়ালেই যেন বদলে যায় বেলঘরিয়ার আদর্শনগরের জনজীবন। গ্যাসের আতঙ্কে তড়িঘড়ি জানলা-দরজার কপাট বন্ধ করে দেন অধিকাংশ বাসিন্দা। তাঁরা বলছেন, জানলা খুললেই ঘরে ঢুকে পড়বে কটূ গন্ধ। দমবন্ধ করা গ্যাসে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
এই দুঃসহ পরিস্থিতি নিয়ে আদর্শনগরের বাসিন্দারা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সদস্য সচিবকে চিঠি লিখে অভিযোগ জানিয়েছেন। কিন্তু সুরাহা হয়নি। এলাকার বাসিন্দা এবং পরিবেশকর্মীরা জানাচ্ছেন, এই উপদ্রবের পিছনে রয়েছে প্রমোদনগরের বিরাট ভাগাড়। সেখানে অন্তত ৬টি পুরসভার যাবতীয় জঞ্জাল জড়ো করা হয়। সন্ধ্যা হলেই সেই জঞ্জালের পাহাড়ে আগুন লাগছে। সেখান থেকেই কটূ গ্যাস বেরিয়ে রীতিমতো দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ভাগাড় সংলগ্ন বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়েও লোকজন সেই গন্ধ টের পাচ্ছেন। মেন লাইনের নিত্যযাত্রী অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘তীব্র গন্ধে দম নেওয়া মুশকিল হয়। কাশি তো হয়ই, অনেকে বমিও করে ফেলেন। সব থেকে কষ্ট হয় ট্রেনে থাকা বৃদ্ধ ও শিশুদের।’’
চিকিৎসকেরা বলছেন, বর্জ্য পোড়ার ফলে সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মোনোঅক্সাইড, হাই়ড্রোজেন সালফাইডের মতো ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি হয়। তার সঙ্গে নানা ধরনের হাইড্রোকার্বনও মিশে থাকে। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বিনয় গুছাইতের মতে, ‘‘এই ধরনের গ্যাস দীর্ঘদিন ধরে শরীরে ঢুকলে হাঁপানি-সহ শ্বাসনালি ও ফুসফুসের নানা ধরনের রোগ হতে পারে। হার্টের সমস্যা তৈরি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।’’ পরিবেশবিদেরা জানান, মিথেন-সহ এই ধরনের গ্যাসগুলিকে ‘গ্রিন হাউস’ গ্যাস বলে। যা পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। ‘‘ফলে শুধু মানুষ নয়, প্রমোদনগরের ভাগাড় থেকে কলকাতার উপকণ্ঠের পরিবেশও মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে,’’ মন্তব্য এক পরিবেশবিদের।
নিত্যযাত্রীদের এই সমস্যার কথা রেলকর্তাদের কানেও পৌঁছেছে। পূর্ব রেলের মুখপাত্র রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘যাত্রীদের স্বাস্থ্য আমাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। দূষণ বন্ধ করতেই হবে। প্রয়োজনে ভাগাড় বন্ধ করার জন্য রাজ্যকে চিঠি দেব আমরা।’’
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, প্রমোদনগর কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, রাজ্যের বেশির ভাগ ভাগাড়েই এমন ঘটনা ঘটে। যার পিছনে বর্জ্য সংক্রান্ত বিধি কার্যকর না হওয়াটাই মূল কারণ। চন্দননগরের ভাগাড়েও এমন গ্যাস বিভ্রাটে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। তা নিয়ে চন্দননগরের মেয়রের কাছে স্মারকলিপি জমা পড়েছে।
কিন্তু আগুন লাগাচ্ছে কে? রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, জঞ্জালের স্তূপ থেকে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়। তা বায়ুর সংস্পর্শে এলেই আগুন ধরে যায়। পরে তা জঞ্জালের স্তূপে ছড়িয়ে পড়ে। এটি চন্দননগরের ক্ষেত্রেও ঘটছে বলে জানান তিনি। ‘‘তবে শুধু মিথেন নয়, জঞ্জাল পুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছাকৃত ভাবেও আগুন লাগানো হয়,’’ বলছেন বিশ্বজিৎবাবু। পাশাপাশি আরও একটি বিপদের কথাও বলছেন বিশ্বজিৎবাবু। তিনি জানান, প্রমোদনগরে জঞ্জালের পাহাড় তৈরি হওয়ায় কাক, চিলের সংখ্যা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। বিমানবন্দরের কাছে এই ভাগাড় ও পাখিদের সংখ্যাবৃদ্ধি বিমানের ক্ষেত্রেও বিপদের আশঙ্কা তৈরি করছে। তিনি বলেন, ‘‘পর্ষদে থাকাকালীন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের তরফে এ নিয়ে অভিযোগ পেয়েছিলাম।’’
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রের দাবি, বিষয়টি নিয়ে ওই এলাকার ৬টি পুরসভার সঙ্গে একাধিক বার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই ভাগাড় বন্ধ করে দিলে নতুন কোনও জায়গায় ভাগাড় তৈরির জায়গা নেই। ‘‘সমস্যা তো হচ্ছেই, কিন্তু তার সুরাহার পথ মিলছে না,’’ মন্তব্য পরিবেশ দফতরের এক কর্তার। তিনি বলেন, এই সমস্যা মেটাতে প্রয়োজন প্রযুক্তি ও জমির। কিন্তু দু’টোর কোনওটাই নেই। তবে বিমানবন্দরের সমস্যার কথা মেনে নিচ্ছেন ওই পরিবেশকর্তাও। বলছেন, বিমান চলাচলে সমস্যা যদি তৈরি হয়, তা হলে এই সমস্যা আরও জটিল আকার নেবে।
গ্যাস থেকে বাঁচতে আকাশের দিকেই এখন তাকিয়ে নাগরিকেরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy