Advertisement
১৮ মে ২০২৪

রাত-জলসা বন্ধে সদিচ্ছা কই পুলিশের

থানার ওসি বলে পরিচয় দিয়ে এক জন ওই বৃদ্ধকে ঝাঁঝিয়ে দাবি করেন, তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলছেন, এলাকার কোথাও কোনও সাউন্ড বক্স বাজছে না। বৃদ্ধ বিস্মিত, ফোনে অভিযোগ জানানোয় তাঁকে মিথ্যেবাদী বলে প্রতিপন্ন করা হচ্ছে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৭ ০২:১০
Share: Save:

বাড়ির পাশে সাউন্ড বক্সে বেজে চলা গান দু’চোখের পাতা এক করতে দিচ্ছে না। সাহায্য চেয়ে তাই লালবাজার কন্ট্রোল রুমে ফোন করেছিলেন ৭৮ বছরের বৃদ্ধ। কলকাতা পুলিশের সদর দফতর স্থানীয় থানাকে খবর দিয়ে ব্যাপারটা দেখতে বলে। সোমবার রাত তখন পৌনে ১১টা। এর পরে থানা থেকে বৃদ্ধ যে ফোনটি পেলেন, তার জন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না।

থানার ওসি বলে পরিচয় দিয়ে এক জন ওই বৃদ্ধকে ঝাঁঝিয়ে দাবি করেন, তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলছেন, এলাকার কোথাও কোনও সাউন্ড বক্স বাজছে না। বৃদ্ধ বিস্মিত, ফোনে অভিযোগ জানানোয় তাঁকে মিথ্যেবাদী বলে প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। শেষমেশ বিহিত চেয়ে ফের কন্ট্রোল রুমে ফোন করায় তাদের হস্তক্ষেপে শব্দ-যন্ত্রণা থেকে রেহাই পান তিনি। জানতে পারেন, থানা থেকে যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি মোটেই ওসি নন, তিনি এক জন সাব-ইনস্পেক্টর, সেই সময়ে থানার ডিউটি অফিসার।

ঘটনাস্থল টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে একটি এলাকা। শুধু ওই জায়গায় নয়, সোমবার বেশি রাত পর্যন্ত মাইক চালিয়ে গানবাজনার অনুষ্ঠান চলেছে বাঘাযতীন, রবীন্দ্রপল্লি ও পাটুলির কিছু তল্লাটে। ওই বৃদ্ধের মতো সর্বত্র অভিযোগ জানানোর উৎসাহ, গরজ ও সাহস সকলের নেই। জলসা তাই দাপটে চলেছে।

লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থানাগুলির সঙ্গে ওই সব অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা একটা বোঝাপড়া করে রাত দশটার পরেও বেআইনি ভাবে মাইক, সাউন্ড বক্স বাজাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে থানা সেটা বন্ধ করবে কী ভাবে?’’

থানার অফিসারেরা আবার দায় চাপাচ্ছেন বড়কর্তাদের উপর। তাঁদের বক্তব্য, থানার ঘাড়ে দোষ চাপানোর আগে সিনিয়র অফিসারদের বোঝা উচিত, পাড়ায় পাড়ায় এই সব জলসার আয়োজক দুর্গাপুজো বা কালীপুজো কিংবা জগদ্ধাত্রী পুজোর কমিটি। যাদের শীর্ষে বা ঘনিষ্ঠ ভাবে সঙ্গে আছেন স্থানীয় প্রভাবশালী কোনও না কোনও নেতা। থানার পুলিশের ঘাড়ে ক’টা মাথা যে, সেই জলসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? শহরের তিন-চারটি থানার ওসি-র একটাই কথা, ‘‘এ বার ডিজে বন্ধ করতে হবে বলে উপরতলা থেকে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশ সিনিয়র অফিসারদের কাছে এসেছিল সরকারের শীর্ষ মহল থেকে। কিন্তু জলসা বন্ধ করতে গিয়ে নেতাদের রোষে পড়লে কি বড়কর্তারা পাশে দাঁড়াবেন?’’

থানার অফিসারদের একাংশ এই ভাবে ‘হাত ধুয়ে’ ফেলার চেষ্টা করলেও সব ক্ষেত্রেই নেতারা হস্তক্ষেপ করেন, এমনটা নয়। আবার পাড়ার জলসায় যে রাত ১০টার পরে মাইক বাজছে, সেটা স্থানীয় নেতাকে জানিয়ে তাঁকে দিয়েও সমস্যা মেটানোর চেষ্টা হয় না। বহু ক্ষেত্রে জলসার পিছনে রাজনৈতিক মদত আছে বলে জানিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার বর্ম খোঁজে পুলিশ। বর্ম অবশ্য আরও একটা আছে। অভিযোগ পাওয়া যায়নি, এমন দাবির বর্ম। দক্ষিণ কলকাতার এক গুরুত্বপূর্ণ থানার অতিরিক্ত ওসির কথায়, ‘‘যখনই ফোন আসে, ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কালীপুজোর ঠিক পরেই ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে আমরা রাত পৌনে ১১টা নাগাদ গিয়ে একটা অনু‌ষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বললাম। উদ্যোক্তারা শুনলেন।’’ কিন্তু ৪৫ মিনিট বেশি বাজার জন্য উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা?

আসলে ট্র্যাফিক সিগন্যাল লাল হয়ে যাওয়ার পরেও স্টপলাইন পেরোনো গাড়ির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পুলিশ যত তৎপর, রাত ১০টার পরে মাইক বাজানোর বিরুদ্ধে ততটা আদৌ নয়। মধ্য কলকাতার এক ওসি বলেন, ‘‘মাইক বন্ধ করে দিয়ে বাজেয়াপ্ত করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।’’

পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক, বর্তমানে পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় কিন্তু বলছেন, ‘‘মাইক বা সাউন্ড বক্স বাজেয়াপ্ত করা সব চেয়ে বড় অস্ত্র। কারণ, ওই সব সরঞ্জাম ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা যাঁদের, এমনটা হলে তাঁরা আর জলসার আয়োজকদের ভাড়া দেবেন না। অতীতে এমনটা বহু বার হয়েছে।’’

কিন্তু মাইক বাজেয়াপ্ত না করা হলেও জলসার উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কি কোনও রকম আইনি ব্যবস্থা নেয়? উত্তর কলকাতার একটি থানার ওসির দাবি, ‘‘ক্যালকাটা পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে পর্ষদের কাছে উদ্যোক্তা সংস্থা বা ক্লাব ও তার পদাধিকারীদের নাম আমরা পাঠিয়ে দিই। এ বারও দিয়েছি।’’

মঙ্গলবার পর্ষদের এক শীর্ষকর্তা অবশ্য বলছেন, ‘‘পুলিশের পাঠানো এমন তালিকা এখনও পাইনি। আর তা ছাড়া, আমাদের কাছে নাম পাঠাতে হবে কেন? পুলিশ নিজেই ব্যবস্থা নিতে পারে। সে ক্ষমতা পুলিশের আছে।’’

তবে সে ক্ষমতা পুলিশ প্রয়োগ করলে তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Police night party
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE