নিহত বৃদ্ধের বাড়িতে পুলিশ। নিউ আলিপুরে। ফাইল চিত্র।
রাতের অন্ধকারে চুপিসাড়ে গৃহস্থের বাড়িতে খালি হাতে প্রবেশ। উদ্দেশ্য তো চুরি। অস্ত্র বহনের তাই প্রশ্ন উঠছে না। কিন্তু চুরির সময়ে বাড়ির বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা কোনও ভাবে জেগে গেলে খালি হাতেই তাকে অবলীলায় খুন করছে চোরেরা। নিউ আলিপুরে বৃদ্ধ খুনের কিনারা হওয়ার পরে লালবাজারের গোয়েন্দারা স্বীকার করছেন, শহরে অপরাধের এটা নতুন প্রবণতা।
সেটি এমন বিপজ্জনক হওয়ায় উদ্বিগ্ন পুলিশ মহল।
৫ অগস্ট গভীর রাতে নিউ আলিপুরে অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার মলয় মুখোপাধ্যায়, গত ১৮ জুন রাতে নেতাজিনগরের বৃদ্ধা গৌরী সেন আর ২০১২-র ২১ অগস্ট চিৎপুরের বাসিন্দা ফুলরেণু চৌধুরী— তদন্তে বেরোল, তিন জনই খুন হন চোরেদের হাতে। ‘‘বলতেই হচ্ছে, এটা শহরের অপরাধে নতুন প্রবণতা,’’ বলছেন এক পোড়খাওয়া গোয়েন্দা অফিসার।
এই নতুন প্রবণতা রুখতে লালবাজারের নিদান— সাধারণ মানুষ সচেতন হোন। আগে কখনও হয়নি বলে ভবিষ্যতে হবে না, এই ভুল ধারণা কাটিয়ে উঠে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকা জরুরি।
তদন্তকারীদের মতে, মলয়বাবুর বাড়িতে ‘বার্গলার অ্যালার্ম’ বা চোর ধরার ঘণ্টি লাগানো থাকলে এত ভয়ঙ্কর ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত। পুলিশের বক্তব্য, ওই বৈদ্যুতিন ঘণ্টি এমন ভাবে বসাতে হবে যে, পাঁচিল থেকে খিড়কির দরজা বা জানলায় কেউ হাত দিলেই তীব্র শব্দে জানান দেবে ঘণ্টি। হাজার দেড়েক টাকা থেকে দশ হাজার টাকা দামের মধ্যে নানা গোত্রের এই ঘণ্টির একটি বসালে গৃহস্থ তাঁর সুরক্ষা কিছুটা নিশ্চিত করতে পারবেন বলে পুলিশের একাংশের অভিমত।
তা ছাড়া, গোয়েন্দারা মনে করছেন, বাড়ির বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলে ও নিয়মিত তার ফুটেজ দেখে কারও গতিবিধি সন্দেহজনক বলে মনে হলে খবর দিতে হবে পুলিশকে। তাতেও সমস্যার সুরাহা হতে পারে। পুলিশ জেনেছে, নিউ আলিপুরের ঘটনায় ধৃত জাকির আর সুরজ আম আর প্লাস্টিক কুড়োনোর ছলে আগে এসে ওই বাড়ির ঢোকা-বেরোনোর পথ দেখে গিয়েছিল।
তবে সকলের আগে স্থানীয় বাসিন্দাদের আত্মকেন্দ্রিকতার খোলস ছেড়ে বেরোতে হবে বলে মনে করছে পুলিশ। এক অফিসার বলেন, ‘‘পাড়ায় অপরিচিত মুখ, সন্দেহজনক গতিবিধি দেখলেই হাঁকডাক, প্রশ্ন করতে হবে। পুরনো এই পাড়া-সংস্কৃতি ফেরাতে হবে অপরাধের নতুন প্রবণতা ঠেকানোর চেষ্টায়।’’
নতুন প্রবণতা মানে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার ভয়ে খুন। লালবাজারের এক অফিসারের কথায়, ‘‘এমন নয় যে চোরেরা সেই গৃহস্থের পরিচিত। রাতে এক জন প্রবীণ নাগরিক কাউকে দেখেই বা কতটা মনে রাখতে পারবেন? তাতেও তারা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে খুন করছে।’’
ওই অফিসার বলেন, ‘‘চোরকে আমরা সাধারণ ভাবে নিষ্ঠুর বা ভয়ঙ্কর অপরাধী বলে ভাবি না। অথচ গৃহস্থ জেগে যাওয়ায় যখনই সে ভাবছে ধরা পড়ে যাবে, তখনই সে খুনের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ করে ফেলছে।’’ এক গোয়েন্দা-কর্তা আবার বলেন, ‘‘কোনও চাপ নিতে পারছে না এখনকার কম অভিজ্ঞ অপরাধীরা। তাদের নিষ্ঠুর মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে এই ধরনের অপরাধের মাধ্যমে।’’
ডাকাতি বা অপহরণ করতে গিয়ে খুনের ভুরি ভুরি নজির অতীতে আছে। চুরি করতে গিয়ে খুনের নজির থাকলেও, তা ছিল তুলনায় কম। তবে এখন তা বাড়ছে কেন?
মনোবিদ অনিন্দিতা চৌধুরীর মতে, ‘‘গোটা সমাজে এখন এক দিকে সহনশীলতার অভাব ও অন্য দিকে নিষ্ঠুরতা তীব্র আকার নিয়েছে। এই সব খুনের ক্ষেত্রে চোরেদের মানসিকতাতেও তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।’’ চুরির সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর জেল। আর খুনে ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এক সময়ে অপরাধ করতে গিয়ে এই সব হিসেব দুষ্কৃতীদের মাথায় থাকত, এখন যার বড় অভাব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy