মহাপঞ্চমীর সন্ধ্যা। আলো ঝলমলে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ। সোমবার। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
ভরসন্ধ্যায় ওয়াকিটকিতে বার্তা পেলেন যাদবপুর থানার মোড়ে দাঁড়ানো এক ট্রাফিক সার্জেন্ট। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, টালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড কার্যত অবরুদ্ধ। ঢাকুরিয়া সেতুর কাছে সার দিয়ে দাঁড়ানো গাড়ি। পঞ্চমীর বিকেল থেকে পুলিশ পুরোদস্তুর নেমেছে রাস্তায়। কিন্তু রাস্তায় নেমেই ট্রাফিকের হাল দেখে মাথায় হাত ওই অফিসারের। সেই যানজট কাটতে কাটতে রাত গড়িয়ে গেল অনেকটাই।
দক্ষিণের মতো একই বার্তা গিয়েছিল বিধান সরণি ও বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে দাঁড়ানো আর এক পুলিশ অফিসারের কাছেও। হাতিবাগান, শ্যামবাজার, অরবিন্দ সরণিতে তখন গাড়ি প্রায় নড়ছেই না! চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে এক সার্জেন্ট তাঁর অধস্তনকে বলছিলেন, “বেহালায় খোঁজ নে। ওখানে ট্রাফিকের এই হাল হলে কিন্তু ভুগতে হবে।” অফিসফেরতা মানুষ আর পুজো দেখতে বেরোনো মানুষের জঙ্গলে তখন ডায়মন্ড হারবার রোড ও জেমস লং সরণি দিয়ে নড়ছে না কোনও যান।
ও দিকে টালিগঞ্জ সার্কুলার রোড আর দুর্গাপুর ব্রিজ দিয়েও কোনও গাড়ি এগোচ্ছিল না বিকেল থেকে। এক ট্রাফিক সার্জেন্টের মন্তব্য, “রবিবার বিকেলেই খুলে গিয়েছে নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘের মণ্ডপ। সোমবার ভোর পর্যন্ত আমাদের ব্যস্ত রেখেছে মানুষ। ফের শুরু হয়েছে এ দিন সকালে। ছত্তিসগঢ়ে শান্তি ফিরুক এটাই এ বার সুরুচির থিম।” সেখানে থেকে ভিড়ের একটা অংশ নিউ আলিপুর সর্বজনীনের বিবেকানন্দ রক দেখে চলে যাচ্ছে বেহালায়। অন্যটা চেতলা ব্রিজ পেরিয়ে চলে আসছে বাদামতলায়।
‘উৎসব কাপ’ শুরু হয়েছিল চতুর্থীতেই। সোমবার, পঞ্চমী সন্ধ্যাতেই ভিড় উপচে পড়ল শহরের আনাচে কানাচে! ভিড়ের দাপটে পুজোর যান শাসনে নেমে প্রথম দিনেই কার্যত হোঁচট খেল কলকাতা পুলিশ। লালবাজার সূত্রের খবর, দুপুর থেকেই যানজট শুরু হয়েছিল উত্তর কলকাতায়। ধীর গতিতে গাড়ি চলছিল দক্ষিণে। কিন্তু সন্ধ্যা গড়াতেই দক্ষিণেও ছড়াল যানজট। যাদবপুর, গড়ফা, কসবা কানেক্টরেও ঢিমে তালে চলেছে গাড়ি।
এ দিন দুপুর থেকেই ভিড় জমেছিল দমদম, টালিগঞ্জ, শোভাবাজার, কবি সুভাষের মতো মেট্রো স্টেশনে। পোশাক দেখেই আঁচ করা যাচ্ছিল, এই ভিড়ের গন্তব্য পুজোমণ্ডপ। মেট্রোর ভিড়ে এক দম্পতিকে বলতে শোনা গেল, “ষষ্ঠীর রাতেই তো উত্তরাখণ্ডের ট্রেন। তাই পঞ্চমীতেই শহর ঘুরে নিচ্ছি।” কেউ কেউ পুজোর ছুটিতে হস্টেল ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরবে। তাই দল বেঁধে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরতে দেখা গিয়েছে কলেজ পড়ুয়াদেরও।
পুলিশ সূত্রে খবর, দুপুর থেকেই উত্তরের টালা বারোয়ারি, শ্যামপুকুর সর্বজনীন, দমদম পার্ক, তেলেঙ্গাবাগানে বেশ ভিড় জমেছিল। তার ফলেই অরবিন্দ সরণি, হাতিবাগান, শ্যামবাজার এলাকায় যানজট তৈরি হয়েছিল। বেলা যত গড়িয়েছে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে হাতিবাগান, কুমোরটুলি, আহিরীটোলার পুজোয়। ভিড়ের পরের গন্তব্য ছিল কলেজ স্কোয়ার, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্ক। ভিড় যে ভাবে এগিয়েছে যানজটও এগিয়েছে যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, কলেজ স্ট্রিট, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের দিকে। বিকেল গড়াতেই উত্তর ও মধ্য কলকাতার বেশির ভাগ অংশই যানজটে আটকে পড়ে।
উৎসবের ভিড় টানার লড়াইয়ে বিকেলে উত্তরকে টেক্কা দিয়েছে দক্ষিণ। সেলিমপুর পল্লি, বাবুবাগান, হিন্দুস্থান পার্ক, একডালিয়া এভারগ্রিন, সিংহি পার্ক, ত্রিধারা সম্মিলনী হয়ে ভিড় গিয়েছে শিবমন্দির-মুদিয়ালির দিকে। ভিড়ের একাংশ গিয়েছে বাদামতলা, ৬৬ পল্লি, চেতলা অগ্রণী, সুরুচি, নিউ আলিপুর হয়ে খিদিরপুরের দিকে। ২৫ পল্লি, পল্লি শারদীয়ার মণ্ডপ দেখার পাশাপাশি এ দিন সন্ধ্যায় লোক জমেছে খিদিরপুর ভেনাস ক্লাবের মণ্ডপেও। সেখানে শতদলে দশভূজা থিম নজর কাড়বে অনেকেরই।
রাসবিহারী থেকে ভিড়ের আর একটা শাখা চলে গিয়েছে হাজরা ২২ পল্লি, রূপচাঁদ মুখার্জি, বকুলবাগান, অবসর, চক্রবেড়িয়া, পদ্মপুকুর বারোয়ারির দিকে। ভিড়ে কম যায়নি ৭৫ পল্লি, অগ্রদূতও।
দক্ষিণ শহরতলিতে ভিড় উপচে পড়েছে নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের মণ্ডপেও। বাঁশদ্রোণীর রায়নগর উন্নয়ন সমিতির মণ্ডপ দেখতে ভিড় জমেছে এনএসসি বসু রোডের উপর থেকেই। রায়পুর ক্লাব, অরুণোদয়ের মণ্ডপেও চোখে পড়েছে ভিড়। সন্তোষপুর লেকপল্লির মণ্ডপে তৈরি হয়েছে বালির ভাস্কর্যে। ভরসন্ধ্যায় ভিড়ের দাপটে সেই ভাস্কর্য সামলাতে নাজেহাল হন বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তারক্ষীরা। ওই এলাকারই শহিদনগর সর্বজনীনে ফুলিয়ার তাঁতের শাড়ি দিয়ে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে। তা দেখতেও ভিড় করেছেন মানুষজন।
দক্ষিণের ভিড় বাড়তে বাড়তে পৌঁছে গিয়েছে বেহালা-হরিদেবপুরের দিকেও। বেহালা এলাকায় সব ক’টি ক্লাবই প্রায় সমানে-সমানে টক্কর দিচ্ছে। পঞ্চমীর সন্ধ্যায় মণ্ডপের সামনে ভিড় দেখে উৎফুল্ল বড়িশা ক্লাবের পুজোকর্তা অনিমেষ চক্রবর্তী। নতুন শিল্পীর গড়া থিম এ ভাবে লোকের নজর কাড়বে, তিনি ভাবতেই পারেননি। নূতন দল এ বার নতুন আঙ্গিকে। সেটাও হিট।
সন্ধ্যায় টালা বারোয়ারি, দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘ, ভারতচক্র, প্রদীপ সঙ্ঘের মতো ক্লাবগুলিতে লম্বা লাইন। সন্ধ্যায় ভিড়-লাইন সামলাতে গিয়ে টালার পুজো উদ্যোক্তা অভিষেক ভট্টাচার্য দলবল নিয়ে রীতিমতো নাজেহাল। বললেন, “পঞ্চমীর সন্ধ্যা বলে একটু ঢিলে দিয়েছিলাম। কিন্তু এ বার ভিড়ের চাপ কেমন হবে, তা হাড়ে হাড়ে মালুম হয়েছে।”
এ দিকে সন্ধ্যায় উত্তরের ভিড় এগিয়েছে বেলেঘাটা, মানিকতলার হয়ে বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি, কাঁকুড়গাছি যুবকবৃন্দ, স্বপ্নারবাগানের মতো পুজোগুলির দিকে। মানিকতলায় লালাবাগান নবাঙ্কুর, হালসিবাগান, চালতাবাগানের মতো ক্লাবগুলিতেও লোকে ভিড় জমিয়েছেন। এরই মধ্যে হাজির হয়েছেন কানাডা, কলম্বিয়া, ব্রিটেন থেকে সাত বিদেশি। সেই দলে যেমন সমাজতত্ত্ববিদ, স্থপতি, নগরায়ণ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদও। একটি পুজো-পুরস্কারের বিচারক হিসেবেই শহরের বিভিন্ন মণ্ডপে ঘুরবেন তাঁরা।
লালবাজারের একাধিক প্রবীণ অফিসার বলছেন, পঞ্চমীর দুপুর থেকেই যে ভাবে লোকে রাস্তায় নেমেছে, তা আগে কখনও দেখা যায়নি। তার উপরে এ দিনই ছিল ছুটি পড়ার আগে কার্যত শেষ কাজের দিন। অফিস-পুজোর ভিড় মিলেমিশে গিয়েই এমন পরিস্থিতি বলে পুলিশের একাংশের দাবি। অনেকেই বলছেন, কলকাতা পুলিশ তো পুজোর ভিড় সামলানোর জন্য চিরকালই নাম কুড়িয়েছে। তা হলে এই অবস্থা কেন?
পুলিশের একাংশের দাবি, পুজোর ভিড় যে ক্রমশ এগিয়ে আসছে, তা গত কয়েক বছর ধরেই মালুম হচ্ছিল। এ বার তাই পঞ্চমী থেকেই পুরোদস্তর রাস্তায় নেমেছে লালবাজার। কিন্তু প্রথম দিনেই যে এমন হোঁচট খেতে হবে, তা আঁচ করতে পারেননি পুলিশকর্তারা। তবে লালবাজারের শীর্ষকর্তাদের আশা, পঞ্চমীর সন্ধ্যা থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে আজ, ষষ্ঠী থেকেই শহর অনেক বেশি সচল হবে। কলকাতা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘পুজোর ট্রাফিক শাসন নিয়ে একটা আগাম ছক থাকে। প্রথম দিন সেই ছকে কোনও গলদ থাকলে ধরা পড়ে। তা শুধরে নিলেই যানজট অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকে।”
আজ, মঙ্গলবার ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় শহরের পথ পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় পরীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy