ফাইল চিত্র।
রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ বা সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে টানাটানিতেই শেষ নয়। চলে এসেছেন শিবঠাকুর এবং গোমাতাও! রণাঙ্গন যথারীতি সেই সোশ্যাল মিডিয়া। এবং তাতে কুশীলব, প্রবীণ রাজনীতিবিদ থেকে জনপ্রিয় টলিউড অভিনেত্রী।
ঠিক খুচরো তরজাতেও আটকে থাকছে না বিষয়টা। দু’জন অভিনেত্রীকেই রীতিমতো নেট-নিগ্রহের মুখে পড়তে হয়েছে। কদর্য ভাষায় আক্রমণ থেকে ধর্ষণের হুমকি— কিছুই বাদ পড়ছে না। এ যাবৎ, জাতীয় রাজনীতির বৃহত্তর পটভূমিতে অন্য কারও কারও ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা গিয়েছে। বাংলায় নামী-অনামী থেকে প্রবীণ-নবীন, নানা বয়সের নারীদের আগেও নিশানা করা হয়েছে। ‘‘বিশেষত মহিলা হলে কোণঠাসা করার উৎসাহটা আরও বাড়ে। এটা বার বারই দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রে প্রভাবশালী রাজনৈতিক শিবির ও তার অনুগামীদের এ বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের ক্ষেত্রেও এমনই দেখেছি,’’— বলছিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের শিক্ষিকা মৈত্রেয়ী চৌধুরী। স্বরা ভাস্কর, রিয়া চক্রবর্তী থেকে শুরু করে পুরুষ প্রতিবাদী কণ্ঠ নাসিরুদ্দিন শাহ, আমির খান বা অনুরাগ কাশ্যপকেও কম-বেশি সংগঠিত ট্রোল-বাহিনীর মুখে পড়ে রীতিমতো অতিষ্ঠ হতে হয়েছে।
ত্রিপুরা, মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল তথা বিজেপি-শিবিরভুক্ত বলে পরিচিত তথাগত রায় কিন্তু এ যাত্রায় উল্টে টলিউডের দুই অভিনেত্রীর দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলছেন। অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনিকে ব্যবহার করে হিংসার প্রবণতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলেছিলেন। তথাগতবাবু তাঁর সঙ্গে টুইট-যুদ্ধে নামেন। এর পরেই সায়নীর টুইটার হ্যান্ডেল থেকে ২০১৫-য় শিবঠাকুরকে নিয়ে বিতর্কিত একটি মিমকে তুলে ধরে তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু হয়। তথাগতবাবু তাতে ধর্মীয় ভাবাবেগ আহত হওয়ার জন্য পুলিশে অভিযোগও দায়ের করেছেন। সায়নী টুইটারে দাবি করেছেন, ২০১৫-র ওই ‘আপত্তিকর টুইট’টির পিছনে কারও অপকীর্তি আছে। তিনি কখনওই কারও ধর্মীয় ভাবাবেগে ঘা দিতে চাননি।
অন্য দিকে, একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে গোমাংস থেকে শুরু করে ইচ্ছেমতো খাবার খাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন দেবলীনা দত্ত। এর জন্য তাঁকেও নেটে নাগাড়ে আক্রমণ ও হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। দেবলীনার তরফে রাজ্য মহিলা কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
তথাগতবাবুর অবশ্য দাবি, ‘‘ওই অভিনেত্রীরাই তো বিষয়গুলি উস্কেছেন।’’ তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, যে ভাবে গোমাংস খাওয়ার কথা ওঁরা বলছেন, ঠিক সে ভাবে কি শুয়োরের মাংস খাওয়ার কথা বলে থাকেন? বাস্তবিক, রাজ্যে সরকারি নিগম থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুয়োরের মাংস বিপণন নিয়ে ছুতমার্গ নেই। হিন্দু ধর্মে গোমাংস ভক্ষণ কি সত্যিই নিষিদ্ধ, সে প্রশ্নও উঠছে।
তথাগতবাবুর মতে, বেদের ব্রাহ্মণ গ্রন্থে গোমাংস ভক্ষণ নিষেধ করা হয়েছে। শাস্ত্রবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর মতে, বিষয়টির নিষ্পত্তি অত সোজা নয়। বিভিন্ন বেদের পরম্পরায় বিভিন্ন ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ গ্রন্থ আছে। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ বছরটাক আগের ব্রাহ্মণ গ্রন্থে কৃষিকাজ ও দুধের জন্য গরুর নানা উপযোগিতার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তখনও যাজ্ঞবল্ক্যের মতো নামী ঋষিরা তুলতুলে গোমাংসের প্রতি পক্ষপাত ব্যক্ত করছেন। নৃসিংহবাবুর মতে, ‘‘বৈদিক যুগে গরু খাওয়ার রীতি ছিল। বাড়িতে ভিআইপি অতিথি এলে গরু কাটা দস্তুর ছিল বলে তাঁদের নামই হয়ে যায় গোঘ্ন। তবে রামায়ণ, মহাভারতের সময়ে নানা দরকারে গরু সংরক্ষণের ঝোঁকও দেখা যায়।’’
কিন্তু ভোট-আবহে এই সব চর্চার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?, প্রশ্ন তুলছেন কবি জয় গোস্বামী। তিনি শঙ্কিত, ‘‘শীর্ষ স্তরের রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই ধর্মের কথা টেনে এনে দেশটাকে ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করছেন। হিন্দু, মুসলিম পরিচয়ের খোপের আড়ালে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের উচিত এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া।’’ মৈত্রেয়ীও বলছেন, ‘‘একটা ভয়ের পরিবেশ। কথার প্যাঁচে ফেলে ব্যক্তিকে ‘ট্রোল’ করার নামে জুলুমবাজি চলছে। জরুরি অবস্থা বা অন্য সময়েও বিরুদ্ধ স্বর দমন করা হয়েছে। কিন্তু এ ভাবে সারা ক্ষণ কোণঠাসা করার কৌশল পুরোপুরি আলাদা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy