Advertisement
০৮ মে ২০২৪

বেলাগাম মদেই বিপদের ফাঁদে কৈশোর

বন্ধুর জন্মদিনে মদ্যপানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের দল। প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার দু’টো ক্লাবে ঢুকেছিল তারা। অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে সুবিধে হয়নি। এর পরে সটান দোকান থেকে পানীয় কিনে বন্ধুর ফ্ল্যাটবাড়ির লনেই তারা জড়ো হয়।

প্রতীকি ছবি

প্রতীকি ছবি

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৬ ০৩:১২
Share: Save:

বন্ধুর জন্মদিনে মদ্যপানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের দল।

প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার দু’টো ক্লাবে ঢুকেছিল তারা। অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে সুবিধে হয়নি। এর পরে সটান দোকান থেকে পানীয় কিনে বন্ধুর ফ্ল্যাটবাড়ির লনেই তারা জড়ো হয়। যার জন্মদিন এবং যার বাড়ির লনে বসল আসর, সেই মেয়েটির মা-বাবা আবাসনেই ছিলেন। হই-হুল্লোড়ের মাত্রা চড়তে থাকায় অন্য কয়েক জন বাসিন্দা কিছুটা আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাতে লাভ হয়নি।

কিন্তু কিশোর-কিশোরীরা এ ভাবে প্রকাশ্যে মদ্যপান করল কী করে? কোথা থেকে তারা প্রশ্রয় পেল? মদের জোগানই বা এল কী ভাবে?

শনিবার বিকেলে বালিগঞ্জের সানি পার্কে আবেশ দাশগুপ্তের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর আলোচনার কেন্দ্রে অপরিণত বয়সে মদ্যপানের বিপদই। আবগারি আইন মোতাবেক কিন্তু একুশ বছরের নীচে কাউকে মদ বিক্রি করা যায় না। সানি পার্কের পার্টিতে জড়ো হওয়া ছেলেমেয়েদের বয়স ছিল বড়জোর ১৬ থেকে ১৮ বছর। জন্মদিনের পার্টিতে কয়েক পাত্তর চড়ানোর পরে সল্টলেকের একটি পাঁচতারা হোটেলে আরও একটা পার্টি করতে যাওয়ার কথা ছিল তাদের। অর্থাৎ নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এ রাজ্যে নাবালকদের মধ্যে অবাধ মদ্যপানের সংস্কৃতি যে গেড়ে বসছে, আবেশের মৃত্যু সেই বাস্তবটাই সামনে এনে দিল।

শহরবাসীর অনেকের অভিজ্ঞতাই বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই ছোটরা হয় লুকিয়ে-চুরিয়ে, নয় প্রাপ্তবয়স্ক কারও সাহায্য নিয়ে মদের বিপণি থেকে সহজেই কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি খুঁজে নেয়। অভিজাত বিপণিতে কর্মচারীদের সাহায্য নিয়ে চোরাগোপ্তা মদ আদায়ের অভিযোগও মাঝেমধ্যে শোনা যায়। আবার সমাজের কোনও কোনও পরিবারে মদ্যপান নিয়ে ছুৎমার্গ কেটে যাওয়ার প্রভাবও দেখা যাচ্ছে কিশোরদের জীবনযাত্রায়। রাজ্যের মদবিক্রেতা ও পানশালার মালিকদের তরফে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেন লিকার কান্ট্রি স্পিরিট অব অ্যান্ড অনশপ হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর জেনারেল সেক্রেটারি গৌতম মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘সবটা কিন্তু দোকানের লোকেদের হাতে থাকে না। বড়রাও কেউ কেউ মদ কিনে ছোটদের হাতে তুলে দিতে সাহায্য করেন।’’

শহরের কিশোর-কিশোরীদের একাংশের ‘স্বাধীন’ জীবনযাত্রা যে মাঝেমধ্যেই মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে, সেটা মানছেন লালবাজারের কর্তারাও। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘এ শহরে প্রায়ই মদ-মাদক নিয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা পার্টিতে মাতামাতি করে! তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। আবার নেশার ঘোরে ছোটখাটো গোলমালের ঘটনায় একটু বকেঝকে ছেড়েও দিতে হয়। মা-বাবারাও প্রভাব খাটিয়ে বাচ্চাদের দোষ ঢাকতে তৎপর থাকেন।’’

সানি পার্কের আবাসনে স্কুলপড়ুয়ারা ঢুকেছিল লেখক অমিত চৌধুরীর কিশোরী কন্যার জন্মদিন উদ্‌যাপন করতে। অমিতবাবু অবশ্য নাবালকদের মদ্যপানের দায় নিতে চাননি। এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি বা আমার স্ত্রী মদ ছুঁই না। আমাদের ফ্ল্যাটে মদ রাখা থাকে না। আমরা কাউকেই মদ সরবরাহ করিনি।’ কিন্তু আবাসন-চত্বরে মেয়ের বন্ধুরা মিলে মদ্যপানের আসর বসিয়েছে, সেটা কী ভাবে চোখ এড়িয়ে গেল তাঁদের? অমিতবাবুর বক্তব্য, তাঁর মা সদ্য গত হয়েছেন। দুপুরে বাড়িতে মায়ের শ্রাদ্ধের বিষয়ে আলোচনা চলছিল। তাই ‘পার্টি’তে কী হচ্ছে, খেয়াল রাখা সম্ভব হয়নি। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আড্ডা মারছিল। সুতরাং কে কোথায় কী করছে সবটা বোঝা সম্ভব ছিল না।

কিন্তু পুলিশের একাংশ থেকে চিকিৎসক-মনোবিদদের অনেকেই মনে করছেন, মদ্যপানের বিষয়টি এড়ানো গেলে বা কড়া হাতে রাশ টানা হলে হয়তো মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটতোই না, তা সে খুনই হোক বা দুর্ঘটনা। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘মদ খেলেই কেউ খারাপ হয়ে যায় না। কিন্তু অপরিণত মননে মদ্যপানের নানা গোলমেলে দিক রয়েছে। হিংসার প্রবণতা তার অন্যতম।’’ চিকিৎসক অরিজিৎ রায়চৌধুরীরও মত, ১৪-১৫ বছর বয়সে মদ খেলে সাংঘাতিক শারীরিক ক্ষতি হয় তা নয়। বিপদটা জড়িয়ে থাকে অপরিণত মননের সঙ্গেই। মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘আজকের ছোটরা টিভি-সিনেমা-ভিডিওগেম থেকে অনেক বেশি হিংসার প্রভাবে অভ্যস্ত। ছোট বয়সে মদ্যপান এই হিংসার বোধটাকে উসকে দেয়।’’

এবং এখানেই পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে শিক্ষাবিদদের বক্তব্য। অমিতবাবু বলছেন, তাঁর মেয়ে মদ্যপানের মধ্যে ছিল না। তা হলে বাড়ির লনে তাঁর মেয়ের বন্ধুরা কী ভাবে নেশায় মেতে ওঠার সাহস পেল, তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন থাকছে। গোখেল মেমরিয়াল স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা ইন্দ্রাণী মিত্র, হেরিটেজ স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা সীমা সাপ্রু বা লা মার্টিনেয়র ফর বয়েজ-এর সচিব সুপ্রিয় ধর স্পষ্টই মনে করছেন, নাবালক ছেলেমেয়ের মদ্যপানে প্রশ্রয় দেওয়াটা খোলা হাওয়া বা মুক্তমনের পরিচয় বলা যায় না। কলকাতার মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত জীবনে মদ্যপান নিয়ে ‘খোলা হাওয়া’র সবটাই ভাল বলে তাঁরা মানতে নারাজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

adolescence trap
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE