এই সেই বাড়ি। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র।
খাতায়-কলমে ভাড়াটে। কিন্তু ভাড়া নেওয়ার আগেই লক্ষ লক্ষ টাকা দিতে হয় বাড়ির মালিককে। কোনও কাগজপত্র ছাড়াই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উচ্ছেদের সময়ে এই টাকা আর ফেরত দেওয়া হয় না।
একবালপুর-সহ বন্দর এলাকার বিভিন্ন পাড়ায় ভাড়াটে বসানোর সময়ে এমন টাকা লেনদেন অর্থাৎ সেলামি নেওয়ার চল রয়েছে। অভিযোগ, ফ্ল্যাট বা বাড়িতে ভাড়াটে বসানোর নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার এই চক্র ক্রমেই বাড়ছে। রবিবার একবালপুরে মা ও দুই মেয়ের হত্যাকাণ্ডের পরে সেলামি চক্রের কথাই জানতে পেরেছে পুলিশ। একই সঙ্গে উঠেছে পুলিশের একাংশের সঙ্গে এই সেলামি চক্রের চাঁইদের যোগাযোগের অভিযোগও।
পুলিশ জানায়, ২০১০ সালে স্বামী প্রদীপ সিহের মৃত্যুর পরে পুষ্পা সিংহ (একবালপুরে নিহত মহিলা) দুই নাবালিকা মেয়েকে নিয়ে একটি ফ্ল্যাট খুঁজছিলেন। তখনই সিকন্দরের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। তার মাধ্যমেই বারো লক্ষ টাকা সেলামি দিয়ে সুধীর বসু রোডের একটি বহুতলের চারতলায় ফ্ল্যাট নেন পুষ্পাদেবী। মাসে মাসে তিনি হাজার টাকা ভাড়াও দিতেন। কিন্তু সম্প্রতি ওই ফ্ল্যাট নিয়েই শুরু হয় গোলমাল।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের একাংশ জানাচ্ছেন, সেলামিতে নেওয়া ফ্ল্যাট বা বাড়ির অধিকারস্বত্ব বিক্রি করা হয়ে থাকে। কিন্তু তারও কোনও কাগজপত্র থাকে না। এ ক্ষেত্রেও পুষ্পাদেবীকে বারো লক্ষ টাকার বিনিময়ে অধিকারস্বত্ব দিতে বলছিল সিকন্দর। কিন্তু পুষ্পাদেবী রাজি হননি। এ নিয়ে বিরোধ চলছিল পুষ্পাদেবী ও সিকন্দরের মধ্যে। শনিবার রাতে সিকন্দরকে গ্রেফতার করার পরে তদন্তকারীরা প্রাথমিক ভাবে নিশ্চিত, ফ্ল্যাট দখল করার জন্যই পুষ্পাদেবী ও তাঁর দুই মেয়েকে হত্যা করেছে সেলামি চক্রের চাঁইরা।
স্থানীয় কাউন্সিলর নিজামুদ্দিন শামস অবশ্য এলাকায় সেলামি চক্রের দাপটের কথা মানতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘আমি এমন অভিযোগ কখনও পাইনি। এলাকায় এমন ঘটনার কথাও আমার জানা নেই।”
তবে পুলিশের একাংশের বক্তব্য, বন্দর এলাকার একবালপুর, মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচে এ ভাবে ফ্ল্যাট দখলের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এবং এই দখলদারির পিছনে পুলিশি মদতও থাকে। যার ফলে ফ্ল্যাট দখলের অভিযোগ জানালে থানার ওসিরা নিষ্ক্রিয় থাকেন বলেও পুলিশকর্তাদের একাংশের অভিযোগ।
বস্তুত, পুষ্পাদেবীর পরিবারের পক্ষ থেকেও পুলিশের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠেছে। এ দিন যখন সিকন্দরের দোকানের মেঝে খুঁড়ে মা ও দুই মেয়ের দেহ উদ্ধার করা হচ্ছে, তখনই পাশের একটি গলিতে বসে কয়েক জন পুলিশ অফিসারের কাছে একবালপুর থানার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিলেন পুষ্পাদেবীর পরিজনেরা। তাঁরা বলছিলেন, প্রথম দিন থেকেই সিকন্দরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু একবালপুর থানার অফিসারদের একাংশ তাঁদের কথা কানে তোলেননি বলে অভিযোগ করেছেন পুষ্পাদেবীর পরিজনেরা।
পুলিশেরও একটি সূত্র জানিয়েছে, অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেই দায় সেরেছিল থানা। সিকন্দরের নামে অভিযোগ শোনার পরে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অভিযোগ করার পরেও গত কয়েক দিনে একবালপুর থানায় সিকন্দরকে বার কয়েক যাতায়াত করতেও দেখা গিয়েছে বলে পুলিশের একাংশের অভিযোগ।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের একাংশের বক্তব্য, সিকন্দরের সঙ্গে স্থানীয় পুলিশের একাংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। অনেক সময়ে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে সিকন্দর। সে কারণেই সিকন্দরের বিরুদ্ধে অভিযোগকে আমল দিতে চাননি থানার অফিসারেরা।
ঘটনাচক্রে, বছরখানেক আগেই কড়েয়ার আমিনুল কাণ্ডে পুলিশ ও স্থানীয় দুষ্কৃতীদের একাংশের যোগসাজশের কথা সামনে এসেছিল। স্থানীয় থানার সোর্স শাহজাদাকে বাঁচাতে গিয়েই ধর্ষণের মতো অভিযোগকে আমল দেয়নি পুলিশ। একবালপুরের ঘটনাতেও পুলিশের একাংশ ও স্থানীয় দুষ্কৃতীদের যোগসাজশের ঘটনা ফের সামনে এল বলে লালবাজারের একাংশ মনে করছে।
যদিও এ দিন কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (প্রশাসন) মেহবুব রহমান ও ডিসি (বন্দর) ভি সলোমন নিশাকুমার থানার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মানতে চাননি।
যুগ্ম কমিশনারের দাবি, “অভিযোগ পাওয়ার পর থেকেই থানা তদন্ত শুরু করেছিল।” তা হলে এত সময় লাগল কেন?
পুলিশকর্তাদের বক্তব্য, অভিযুক্তদের মোবাইল ফোনের ‘কল ডিটেলস’ জোগাড় করতে একটু সময় লেগেছে। যদিও লালবাজারের একটি সূত্রের দাবি, কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পরে শনিবার বন্দর পুলিশের বিশেষ দলকে (এসএসপিডি) কাজে লাগানো হয়। তড়িঘড়ি কল ডিটেলস এবং স্থানীয় সূত্র মারফত খবর জোগাড় প্রথমে সিকন্দরকে পাকড়াও করা হয়। পরে গ্রেফতার করা হয় বাকি তিন জনকে।
পুলিশ সূত্রের খবর, জেরায় সিকন্দর প্রথমে খুনের কথা কবুল করতে চায়নি। কিন্তু মহম্মদ আমিন নামে আর এক অভিযুক্ত খুনের কথা কবুল করে। তার পরেই জেরায় ঘটনার কথা স্বীকার করে নেয় সিকন্দরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy