Advertisement
১৮ মে ২০২৪

ফের সিন্ডিকেট-সংঘর্ষ, অস্বস্তি বাড়ছে শাসকের

সিন্ডিকেটের জালে আরও জড়িয়ে যাচ্ছে তৃণমূল! অস্বস্তি সামাল দিতে নেতাদের পরস্পর-বিরোধী বক্তব্য ক্রমশ বিড়ম্বনায় ফেলছে শাসক দলকে। এর আগে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যা বলেছিলেন, এ দিন তা কার্যত খারিজ করে দিলেন মুকুল রায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের বিবৃতি। পুরো ঘটনার জন্য দলেরই এক নেতা বিজেপির ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছিলেন।

জ্বলছে তৃণমূলের কার্যালয়। মঙ্গলবার রাতে নিউ টাউনে।—নিজস্ব চিত্র।

জ্বলছে তৃণমূলের কার্যালয়। মঙ্গলবার রাতে নিউ টাউনে।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৪ ০৩:২৩
Share: Save:

সিন্ডিকেটের জালে আরও জড়িয়ে যাচ্ছে তৃণমূল! অস্বস্তি সামাল দিতে নেতাদের পরস্পর-বিরোধী বক্তব্য ক্রমশ বিড়ম্বনায় ফেলছে শাসক দলকে। এর আগে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যা বলেছিলেন, এ দিন তা কার্যত খারিজ করে দিলেন মুকুল রায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের বিবৃতি। পুরো ঘটনার জন্য দলেরই এক নেতা বিজেপির ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছিলেন। সব্যসাচীবাবু প্রকাশ্যেই সে অভিযোগ উড়িয়ে দলের অন্য গোষ্ঠীর দিকে আঙুল তুলেছেন।

সিন্ডিকেট নিয়ে নিউ টাউন কতটা উত্তপ্ত, তার উদাহরণ মিলেছে মঙ্গলবার রাতেও। কয়েক দিন আগেই নিউ টাউনের রামকৃষ্ণপুরে সিন্ডিকেটের অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছিল। আর মঙ্গলবার রাতে নিউ টাউনেরই তারুলিয়ায় তৃণমূলের কার্যালয়ে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দেয়। এ বারও অভিযোগ দলেরই এক গোষ্ঠীর দিকে। এই ঘটনায় বুধবার রাত পর্যন্ত অবশ্য কেউ গ্রেফতার হয়নি। উত্তেজনা থাকায় এলাকায় পুলিশের টহলদারি ছিল সারা দিন।

এই ঘটনাকে রোগের উপসর্গ হিসেবেই দেখছেন রাজনীতির লোকজনেরা। তাঁদের বক্তব্য, মূল রোগটা তৃণমূলের অন্দরে। নিউ টাউনে সিন্ডিকেটরাজের দখল নিয়ে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে রেষারেষি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, তা এখন সামলানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে পরপর সংঘর্ষ এবং নিজেদের দলের পার্টি অফিসে ভাঙচুর বা আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটছে।

বস্তুত, গোষ্ঠী-সংঘর্ষের এই বাড়বাড়ন্তে নড়েচড়ে বসেছেন তৃণমূল নেতৃত্বও। অভিযোগ উঠেছে, বারাসতের দলীয় সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার এবং নিউ টাউন-রাজারহাটের বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের অনুগামীদের মধ্যেই বারবার সংঘর্ষ হচ্ছে। রামকৃষ্ণপুরের ঘটনায় সব্যসাচীর অনুগামীদের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে। মঙ্গলবারের ঘটনায় অভিযুক্ত কাকলির অনুগামীরা।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আজ, বৃহস্পতিবার কাকলিদেবী, সব্যসাচীবাবুকে নিয়ে বৈঠকের পরিকল্পনা নিয়েছেন মুকুলবাবু। বৈঠক হওয়ার কথা বিধানসভায় খাদ্যমন্ত্রী তথা দলের উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কক্ষে। সেই বৈঠকে বিধাননগরের বিধায়ক সুজিত বসু, শ্রমমন্ত্রী তথা রাজারহাট-গোপালপুরের বিধায়ক পূর্ণেন্দু বসু এবং বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তীকেও ডাকা হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে খবর। জ্যোতিপ্রিয়বাবুর ঘরে এ দিনও নিউ টাউনের ঘটনা নিয়ে জেলার নেতা ও বিধায়কদের সঙ্গে মুকুলবাবুর কথা হয়েছে। তবে প্রকাশ্যে তাঁরা কেউই সিন্ডিকেট-বিবাদের কথা স্বীকার করেননি। মুকুলবাবু জানিয়েছেন, নিউ টাউনের ঘটনা তিনি জানেনই না। তাঁর সাফ কথা, “সিন্ডিকেটের সঙ্গে আমাদের দলের কেউ যুক্ত নয়।”

আর এ কথা বলেই পার্থবাবুর সাম্প্রতিক বিবৃতিকে কার্যত খারিজ করে দিয়েছেন মুকুলবাবু। রামকৃষ্ণপুরের ঘটনার পরে দলের মহাসচিব পার্থবাবু মেনে নেন, সিন্ডিকেটের সমস্যা দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাঁর বক্তব্য ছিল, “কোনও ঘটনাই আমাদের দৃষ্টির বাইরে নেই। এটা দলের ব্যাপার। আমাদের দেখতে দিন।” অথচ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুলবাবুর দাবি, “জমি-হারারাই সিন্ডিকেট করে। আমাদের দলের সঙ্গে সিন্ডিকেটের কেউ নেই।” নিউ টাউনের ঘটনার সঙ্গেও দলের কেউ জড়িত নয়। প্রশ্ন উঠেছে, দলের কেউ জড়িত না-থাকলে এলাকার সাংসদ-বিধায়কদের নিয়ে বৈঠক ডাকতে হচ্ছে কেন? এর সদুত্তর মেলেনি। একই সুরে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমেরও দাবি, “নিউ টাউনে যারা সিন্ডিকেটে যুক্ত, তারা তৃণমূলের নয়। যারা গণ্ডগোল করছে, তাদের গ্রেফতার করতে বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে ফোন করেছি।” পার্থবাবুর মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মুকুলবাবু অবশ্য বলেছেন, “উনি আসলে বলতে চেয়েছেন, দলের মধ্যে ঝামেলা থাকলে সেটা আমরা দেখব।” পার্থবাবুর ব্যাখ্যা জানা যায়নি। বারবার চেষ্টা করা হলেও দলের মহাসচিব ফোন ধরেননি।

এটা যদি হয় প্রথম অস্বস্তি, পরেরটি হচ্ছে একই ঘটনায় তৃণমূল নেতাদের পরস্পর-বিরোধী দাবি ঘিরে। তারুলিয়ার ঘটনায় অভিযোগের তির সাংসদ কাকলিদেবীর অনুগামী বলে পরিচিত স্থানীয় তৃণমূল নেতা রাজীব দাসের দিকে। রাজীববাবু এ দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি বা আমার কোনও ঘনিষ্ঠ এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নন। এলাকার কিছু বিজেপি সমর্থক তৃণমূলকে হেয় করতে এই কাজ করেছে!” সেই দাবি খারিজ করেছেন তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচীই! তাঁর বক্তব্য, “কোনও দলের নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে লাভ নেই। লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূলে কিছু দুষ্কৃতী ঢুকেছে, তারাই এ সব করছে। সেই দুষ্কৃতীরা কাদের ছত্রচ্ছায়ায় আছে, পুলিশকে তা ভাল করে দেখতে অনুরোধ করছি।” সব্যসাচীবাবুর আশঙ্কা, “পুলিশ কড়া হাতে দমন না করলে নিউ টাউন-কেষ্টপুর সংলগ্ন এলাকায় অশান্তি থামবে না।”

কাকলিদেবী বুধবার দিল্লিতে ছিলেন। তিনি বলেন, “সংসদের অধিবেশনে রয়েছি। কী ঘটেছে, জানা নেই।” অন্য দিকে, বিজেপির নাম জড়িয়ে যাওয়ায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। তাঁর বক্তব্য, “সব সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এখন সিপিএম পরিচালিত সব সিন্ডিকেটই তৃণমূলের হয়ে গিয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। এর সঙ্গে বিজেপি-র কোনও সম্পর্ক নেই।”

মঙ্গলবার রাতে কী ঘটেছিল? স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, রাত ১২টা নাগাদ হইচই শুনে তাঁরা দেখেন, দরমার বেড়া দেওয়া তৃণমূলের কার্যালয়টি জ্বলছে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, “কিছু বোঝার আগেই দেখি, কয়েক জন যুবক মোটরসাইকেল নিয়ে নিউ টাউনের দিকে চলে গেল। আগুনের তেজ এতটাই ছিল যে মনে হচ্ছিল, পাশের ফ্ল্যাটেও ছড়িয়ে পড়বে।” আগুন অবশ্য স্থানীয়রাই নিভিয়ে ফেলেন। তবে তত ক্ষণে ক্লাবের আলমারি, টিভি, ক্যারম বোর্ড সব পুড়ে ছাই। মহিষবাথান ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য রেণু মণ্ডল বলেন, “অফিসের ভিতরে তৃণমূলের পতাকা ছাড়াও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় ছবি ছিল। সে সবও পুড়ে গিয়েছে।”

যে কার্যালয়টি পুড়েছে, তার পিছনেই তারুলিয়া ফুটবল মাঠ সংলগ্ন ক্লাবে এ দিন এলাকার তৃণমূল সর্মথকেরা জড়ো হন। নিজেদের সব্যসাচীর অনুগামী বলে পরিচয় দিয়ে তাঁদের অভিযোগ, শুধু আগুন লাগানোই নয়, ওই কার্যালয়ে আসার ‘অপরাধে’ গণেশ হালদার নামে ১৪ বছরের এক কিশোরকে ওই দিন বিকালেই বেধড়ক পিটিয়েছে কয়েক জন যুবক। মাথায় ব্যন্ডেজ, হাতে প্লাস্টার বাঁধা গণেশের কথায়, “কয়েক জন যুবক আমাকে তাড়া করে এসে বেধড়ক মারে। তাদের মধ্যে এক জন বন্দুকের বাঁট দিয়েও মারে।” এলাকার তৃণমূল সর্মথকদের দাবি, ওই কিশোরকে যারা মারতে এসেছিল, তারাই রাতে তৃণমূলের ওই দলীয় কার্যালয়ে আগুন লাগায়। এই নিয়ে থানায় অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

syndicate clash newtown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE