কলিং বেল শুনে সে জিজ্ঞেস করেছিল, কে? দরজার বাইরে থেকে পরিচিত কণ্ঠে জবাব আসে, “আমি। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি নিয়ে এসেছি।”
দ্বিধা না-করে নিশ্চিন্তে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়েছিল চোদ্দো বছরের কিশোরী। ভুল ভাঙল তখন, যখন সেই ‘মিস্ত্রি’রাই তার মাথায় বসিয়ে দিল ভারী হাতুড়ির ঘা। আর্তনাদ শুনে ছুটে এসেছিল বারো বছরের বোন। তারও দশা হল দিদির মতো। হাতুড়ির আঘাতে রক্তাক্ত দুই বোনের মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাদের গলা টিপে শ্বাসরোধ করা হল।
মেয়েরা শেষ। এ বার মায়ের পালা। ঘরের ভিতরে আততায়ীরা ওত পেতে থাকে। মা কিছুক্ষণ বাদে বাইরের কাজ সেরে ফ্ল্যাটে ঢুকলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ঘিরে ধরে মাথায় হাতুড়ির বাড়ি। শ্বাসরোধ। শেষে প্লাস্টিকে মুড়ে, ট্রাঙ্কে পুরে তিনটি দেহ বাইরে পাচার ও লোপাটের চেষ্টা।
গত ২৯ মার্চ খাস কলকাতার একবালপুরে, থানার ঢিল ছোঁড়া দূরত্বের এক বহুতলে ঠিক এই ভাবে ঘটনাটি ঘটেছিল বলে পুলিশের দাবি। তার দু’সপ্তাহ বাদে, রবিবার স্থানীয় এক মণিহারি দোকানের মেঝে খুঁড়ে মা ও মেয়েদের দেহ উদ্ধার হয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, ফ্ল্যাটের দখলদারি ঘিরে বিবাদের জেরেই হত্যাকাণ্ড। নিহতেরা হলেন পুষ্পা সিংহ (৩৭) এবং তাঁর দুই মেয়ে প্রদীপ্তি (১৪) ও আরাধনা (১২)। মণিহারি দোকানটির মালিক-সহ ধরা পড়েছে চার জন। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (প্রশাসন) মেহবুব রহমান এ দিন বলেন, “পুষ্পাদেবী ও তাঁর মেয়েদের খুন এবং লাশ গুম করার অভিযোগে মহম্মদ সিকন্দর, মহম্মদ আমিন, আসিফ হামজা ও এক কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিকন্দরের দোকানের মেঝে খুঁড়েই দেহ তিনটি পাওয়া গিয়েছে।”
অভিযুক্তদের বয়ানের ভিত্তিতে পুলিশের দাবি: পূর্ব পরিচিতির সুবাদে সিকন্দরই মিস্ত্রিবেশী আততায়ীদের ফ্ল্যাটে ঢুকিয়েছিল। এলাকায় অবশ্য সিকন্দরের বিরুদ্ধে তেমন পুরনো কোনও অভিযোগ নেই। পুলিশ-সূত্রের খবর, এক সময় সে ডেনমার্কে শ্রমিকের কাজ করত। ২০১০-এ দেশে ফিরে মণিহারির দোকান দেয়। পাড়ায় একটা সেলুনও চালায়। পরিবারটির সঙ্গে সে জড়াল কী ভাবে?
পুলিশের বক্তব্য: পুষ্পাদেবীর স্বামী প্রদীপ সিংহ কলকাতায় এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় চাকরি করতেন। ২০১০-এ তিনি ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পরে ক্ষতিপূরণের অর্থে একবালপুরের ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন পুষ্পা, যে বাবদ সিকন্দর তাঁর থেকে ১২ লক্ষ টাকা সেলামি আদায় করে। কারণ, ফ্ল্যাটের মূল মালিক না-হলেও ভোগসত্ব ছিল তারই নামে। আর সেই সূত্রেই পুষ্পাদেবীদের সঙ্গে তার পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু সম্প্রতি সিকন্দরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন পুষ্পা। কেন?
সিকন্দরের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে, পুষ্পাদেবী ফ্ল্যাট ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। সিকন্দর চেয়েছিল, কয়েক লক্ষ টাকা নিয়ে পুষ্পাদেবী ফ্ল্যাটের অধিকার তাকেই ফিরিয়ে দিয়ে যান। তবে সেই দর পুষ্পাদেবীর পছন্দ হয়নি বলে সিকন্দর জেরায় জানিয়েছে। তার দাবি, পুষ্পাদেবী অন্য এক জনকে বেশি দরে ফ্ল্যাটের স্বত্বাধিকার বেচতে চাইছিলেন। এমতাবস্থায় মরিয়া সিকন্দর ওঁর গোটা পরিবারকে গুম করে নিজেকে স্বত্বাধিকারী হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছিল বলে তদন্তকারীদের প্রাথমিক অনুমান। বস্তুত পুলিশ এ-ও জানতে পেরেছেন, পুষ্পাদেবীরা নিখোঁজ হওয়ার পরে সিকন্দর পাড়ার লোকজনকে বলেছিল যে, ভাড়াটেরা ফ্ল্যাটের সত্ব তাকেই দিয়ে গিয়েছেন।
খুনের কথা ফাঁস হল কী ভাবে?
পুলিশ-সূত্রের খবর, পুষ্পাদেবীর বাপের বাড়ি উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে। তাঁর বাবা পরেশনাথ সিংহ ২৯ মার্চ রাত থেকে মেয়েকে ফোনে ধরতে না-পেরে ৩০ তারিখে পুষ্পাদেবীর ফ্ল্যাটে লোক পাঠিয়েছিলেন। সে গিয়ে দেখে, ফ্ল্যাট তালাবন্ধ। সে দিনই পরেশনাথবাবু ফোনে একবালপুর থানার ওসির কাছে নিখোঁজ-ডায়েরি করেন। ৩১ তারিখে কলকাতায় এসে পুষ্পাদেবীর পরিজনেরা একবালপুর থানায় অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন।
দেহ উদ্ধারের কাজ চলছে একবালপুরের ওই দোকানে। ছবি: সুমন বল্লভ।
লালবাজারের খবর, এর পরে ওঁরা বারবার থানায় গিয়ে খোঁজ-খবর করেছেন, সিকন্দরের সঙ্গে পুষ্পাদেবীর বিরোধের কথাও বলেছেন। তবু সিকন্দরকে ধরতে এত সময় লাগল কেন, লালবাজারের একাংশে সে প্রশ্ন উঠেছে। জানা গিয়েছে, প্রায় দু’সপ্তাহ বাদে, শনিবার পুলিশ সক্রিয় হয়। বন্দর পুলিশের বিশেষ দল (এসএসপিডি) তদন্তে নামে। রাতেই পাকড়াও হয় সিকন্দর-সহ চার জন।
খুনের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে পুলিশ জানিয়েছে, নিজের দুই আত্মীয় আমিন-আসিফ ও কিশোরটিকে মোটরবাইকের টোপ দিয়ে সিকন্দর দলে টেনেছিল। খুনের ক’দিন আগে তারা দু’টো ট্রাঙ্ক, প্লাস্টিক, হাতুড়ি কিনে এনে মজুত করে সিকন্দরের ঘরে। সিকন্দর বাড়ির লোককে বলেছিল, ব্যবসার কাজে ওগুলো দরকার। ২৯ মার্চ দুপুর দেড়টা নাগাদ পুষ্পাদেবী ওষুধ কিনতে বেরোলে সিকন্দর তিন সঙ্গীকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সাজিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকায়। প্রথমে প্রদীপ্তি ও পরে আরাধনাকে খুন করা হয়। মিনিট দশেক পরে পুষ্পাদেবী ফিরলে তাঁকেও হাতুড়ি মেরে, গলা টিপে হত্যা করা হয়। এর পরে এক দুষ্কৃতী বেরিয়ে গিয়ে সিকন্দরের বাড়ি থেকে ট্রাঙ্ক, প্লাস্টিক নিয়ে আসে। প্লাস্টিকে মুড়ে দেহগুলো ট্রাঙ্কে পোরা হয় পুষ্পাদেবীকে একটায়, দুই মেয়েকে আর একটায়। ঘরের রক্তের চিহ্ন ধুয়ে-মুছে আততায়ীরা ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে চলে যায়। সন্ধেবেলা সিকন্দরের দোকানের মেঝেয় তিন ফুট খোঁড়া হয়। পর দিন, অর্থাৎ ৩০ মার্চ ভোরে ফ্ল্যাট থেকে ট্রাঙ্ক এনে প্লাস্টিকে মোড়া দেহগুলো বার করে গর্তে পুঁতে মাটি চাপা দেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়। কোনও সন্দেহের যাতে অবকাশ না-থাকে, সে জন্য তিন দিন পরে, অর্থাৎ ২ এপ্রিল দোকানের মেঝে কংক্রিটে বাঁধিয়ে দেয় সিকন্দর। এমনকী, তার উপরে আঠা দিয়ে ‘ম্যাট’ লাগানো হয়।
পুলিশ জানাচ্ছে, শনিবার রাতে ধৃতদের মুখে গোটা ঘটনা জানার পরে সুধীর বসু রোডে সিকন্দরের ওই বন্ধ দোকানের মেঝে খোঁড়ার প্রস্ততি শুরু হয় এ দিন সকালে। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ বিপর্যয় মোকাবিলার কর্মীরা মাটিতে কয়েক ঘা গাঁইতির কোপ মারতেই পচা গন্ধ বেরোতে শুরু করে। ঘণ্টা দুয়েক বাদে একে একে দেহ তিনটি তোলা হয়। দুর্গন্ধে তখন ওই তল্লাটে টেকা দায়। বেলা আড়াইটে নাগাদ শববাহী গাড়িতে দেহগুলি যখন এসএসকেএমের মর্গে পাঠানো হচ্ছে, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছেন পুষ্পাদেবীর পরিজনেরা। “ভাবতে পারিনি, মেয়ে-নাতনিদের ওরা একেবারে মেরে ফেলবে!” রুদ্ধ স্বরে বলেন পরেশনাথবাবু।
পুলিশ জানিয়েছে, এ দিনও লালবাজারের হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দারা ধৃতদের দফায় দফায় জেরা করেছেন। যদিও হাতুড়ি বা ট্রাঙ্কের হদিস মেলেনি। লালবাজারের একাংশের দাবি, থানা সক্রিয় না-হওয়ায় সিকন্দর এত দিন এলাকায় বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রহস্যের মোড় ঘোরাতে নতুন ছকও কষেছিল। কী রকম? গোয়েন্দা-সূত্রের বক্তব্য: পরেশনাথবাবু থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরে পুষ্পাদেবীর মোবাইল নম্বর থেকে সিকন্দর জনৈক ‘পাপ্পু’র পরিচয়ে তাঁকে বেশ ক’বার ফোন করে। পাপ্পু পুষ্পাদেবীর চেনাশোনা। পাপ্পুরূপী সিকন্দর পরেশনাথবাবুকে জানায়, মেয়ে-নাতনিরা তার হেফাজতে রয়েছে, পাঁচ লাখ টাকা দিলে ছাড়া হবে। পুলিশের দাবি, পরেশনাথবাবু তার কথামতো সেই টাকা নিয়ে হাওড়া স্টেশনে গিয়েওছিলেন। তবে কারও দেখা পাননি।
রবিবার রাতে একবালপুর থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি শনিবার থানায় গিয়ে অভিযুক্তদের ছাড়ানোর চেষ্টা করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy