স্মৃতি: নকুল মাহাতোর ঘরে তাঁরই ছবি। নিজস্ব চিত্র
আসা যাওয়ার পথের ধারে চোখে পড়বে বাড়িটা। পুঞ্চার নপাড়া গ্রামের একেবারে দক্ষিণে। একতলার পরে ইঁটের উপরে ইঁট গাঁথা হতে হতে থেমে গিয়েছে কখনও। কিছুটা অংশে প্লাস্টার হয়নি। এখানেই থাকতেন নকুল মাহাতো। পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের সিপিএমের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক।
বাড়ির দেওয়ালে পঞ্চায়েত ভোটে বাম প্রার্থী, নকুলবাবুর নাতি অলিম্পিক মাহাতোকে ভোট দেওয়ার জন্য প্রচার লেখা হয়েছিল। জলে-হাওয়ায় মলিন সেই অভিজ্ঞান ভোট পার করেও থেকে গিয়েছে। উলটো দিকের মাটির দেওয়ালেই প্রতীকী পদ্মফুল। সুনসান দুপুরে উঠোনে ক’টা মুরগি চরে বেড়াচ্ছে। ধান সেদ্ধ করার হাঁড়িটা এক পাশে হেলে। বারান্দায় ধানের মরাইয়ের আড়ালে দেওয়ালে ঝুলছে নকুলবাবুর ছবি।
কিন্তু এমন ছিল না একটা সময়ে। তখন বাম জামানা। পুরুলিয়ার রাজনীতির অনেক জল এই বাড়িটা হয়ে গড়িয়েছে সেই আমলে। নকুলবাবুর হাত ধরেই বাম রাজনীতির শিকড় একটা সময়ে ছড়িয়েছিল পুরুলিয়ার মাটিতে। মাওবাদী সক্রিয়তার সময়ে টালমাটাল নানা পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন তিনি। বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির সঙ্গে বোঝাপড়ার ব্যাপারেও তিনিই ছিলেন ভরসা।
তখন তাবড় তাবড় লোকজনের আনাগোনা তখন লেগেই থাকত নপাড়ার এই বাড়িটায়। ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতার পালাবদল ঘটে গেল। তার পরেও অনেক দিন বাড়িটার গুরুত্ব কমেনি। এ বারে পুরুলিয়া কেন্দ্র থেকে বামফ্রন্টের প্রার্থী হয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের বীরসিংহ মাহাতো। প্রচারে নেমেই এসেছিলেন নপাড়ার বাড়িটিতে। আগেও একাধিক বার জেলার সাংসদ ছিলেন বীরসিংহবাবু। বলছিলেন, ‘‘প্রত্যেক বার নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরে নকুলদার আশীর্বাদ নিতে আসতাম। এই প্রথম উনি আমাদের সঙ্গে নেই। তবু বাড়িটায় এসে মনে হয়, আছেন। অলক্ষ্যে।’’
নকুলবাবুর বড় ছেলে সাম্যগোপাল মাহাতো এবং তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। পরিবার নিয়ে থাকেন মেজো এবং ছোট ছেলে। অলিম্পিক বলছিলেন, ‘‘দাদু ঘুম থেকে ওঠার আগেই দেখতাম দরজার কাছে ভিড়। অনেকেই নানা সমস্যা নিয়ে আসতেন। তাঁদের কথা শুনে ফোনে কাকে কী সব নির্দেশ দিতেন। ভোটের সময়ে তো দিনরাত গমগম করত বাড়িটা।’’ ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হয়েছেন নকুলবাবু। তাঁর দুই মেয়ে সাম্যপ্যারী এবং সাম্যশান্তি সক্রিয় বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সাম্যপ্যারী দু’বারের বিধায়ক ছিলেন। সাম্যশান্তি ছিলেন সিপিএমের মহিলা সংগঠনের জেলানেত্রী। নকুলবাবুর মেজো ছেলে সাম্যকাম হুড়ার একটি স্কুল থেকে শিক্ষক হিসাবে অবসর নিয়েছেন। ছোট ছেলে সাম্যবিপ্লব গ্রামেরই স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
বাম জমানায় অর্ধ্বশতক ধরে দলের জেলা সম্পাদক পদে থেকেও সাধারণ জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী ছিলেন নকুলবাবু। সাম্যবিপ্লববাবু সরাসরি রাজনীতি না করলেও বামেদের শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বলছিলেন, ‘‘বাবা বেঁচে থাকার সময়ে বাড়িতে যেন উৎসব লেগে থাকত। অনেক সময় দেখেছি, বাবার বাড়ি ফিরে আসার অপেক্ষায় কেউ কেউ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে রয়েছেন। ভোটের সময়ে তো আমরাই কথা বলার সুযোগ পেতাম না।’’
পুঞ্চা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশে সিপিএমের পার্টি অফিস। সেখানে গিয়ে দেখা হল দলের জেলা কমিটির সদস্য বিপত্তারণ শেখরবাবুর সঙ্গে। বললেন, ‘‘নির্বাচনের সময়ে বিভিন্ন ব্লকে কাজ সেরে হয়তো রাত ১০টা নাগাদ আসতেন পার্টি অফিসে। টেবিলে মুড়ি আর গরম পাকোড়া থাকত। কর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় কখন যে সকাল হয়ে যেত, টেরই পেতাম না।’’
এখনও ভোটের উত্তেজনা তেমনই টানটান। চাঁদের কাস্তে মিলিয়ে যায় ভোরের আলোয়, কাজের ফাঁকে টের পান না নেতাকর্মীরা। কিন্তু প্রয়াত নেতার বাড়িতে তাঁর ছবির সামনের ধানভরা মড়াইয়ে কোথায় যেন খাঁ-খাঁ করে, মনে হয় বিপত্তারণবাবুদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy