Advertisement
১৭ মে ২০২৪
হুঁশ নেই রাজ্যের

ফল-সব্জি রফতানিতে সফল চাতরা

যথাসম্ভব কম কীটনাশক ও বেশি জৈব সার ব্যবহার করে মছলন্দপুরের প্রত্যন্ত চাতরা গ্রামে ফল-সব্জি চাষ করেছিলেন রবিউল মণ্ডল। বিদেশের বাজার মাত করেছে তাঁর ফলন। শুধু রবিউলই নন। তাঁর মতো যে সব চাষিরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করে আধুনিক প্যাক হাউসে ফল ও সব্জি বাক্সবন্দি করে পাঠিয়েছিলেন, সাফল্য পেয়েছেন সকলেই।

সুভাষনগরের একটি বেসরকারি প্যাক-হাউসে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

সুভাষনগরের একটি বেসরকারি প্যাক-হাউসে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৫ ০৪:০৯
Share: Save:

যথাসম্ভব কম কীটনাশক ও বেশি জৈব সার ব্যবহার করে মছলন্দপুরের প্রত্যন্ত চাতরা গ্রামে ফল-সব্জি চাষ করেছিলেন রবিউল মণ্ডল। বিদেশের বাজার মাত করেছে তাঁর ফলন।

শুধু রবিউলই নন। তাঁর মতো যে সব চাষিরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করে আধুনিক প্যাক হাউসে ফল ও সব্জি বাক্সবন্দি করে পাঠিয়েছিলেন, সাফল্য পেয়েছেন সকলেই।

যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গোটা ইউরোপে রফতানি হওয়া পণ্যের মান নির্ধারণ করে, তাদের পণ্য বাতিলের ভারতীয় তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম রয়েছে সকলের নীচে। ভারত থেকে রফতানি করা ফল-সবজি নিম্নমানের বলে গণ্য করা হলে ওই রাজ্যওয়াড়ি তালিকায় ঠাঁই হয়।

কী ভাবে এই সাফল্য পাওয়া সম্ভব হল, তা হাতে-কলমে শিখতে শনিবার এই রাজ্যে এসেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি পরামর্শদাতা এস এন সুশীলের মতো বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুর মতো বিভিন্ন রাজ্যের কৃষি অধিকর্তা, কর্মী ও রফতানিকারীরা। সল্টলেকে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের ‘বনস্পতি সংরোধ কেন্দ্র’-এর সভাঘরে বৈঠক করার পর বারাসত সুভাষনগরে এক বেসরকারি সংস্থার প্যাক হাউসে যান তাঁরা। কর্মী, চাষি, রফতানিকারী এবং রাজ্যের কৃষি অধিকর্তার সঙ্গে বিশদে কথাও বলেন।

বনস্পতি সংরোধ কেন্দ্রের রাজ্য সহ-অধিকর্তা প্রদ্যোৎ ঘোষ বলেন, ‘‘আগে বিদেশে রফতানির পরে যত ফল-সব্জি বাতিল হত, তার তুলনায় এখন তা হচ্ছে অতি সামান্য। উৎকৃষ্ট মানের ফসল তৈরি করে কৃষকদের লাভবান করাটাই আমাদের উদ্দেশ্য।’’ দেশে সবচেয়ে বেশি ফল ও সব্জি রফতানি করে মুম্বই। সেখানকার বনস্পতি সংরোধ কেন্দ্রর যুগ্ম অধিকর্তা জে পি সিংহ পশ্চিমবঙ্গের সাফল্যে মুগ্ধ। দিল্লির বনস্পতি সংরোধ কেন্দ্রের সহ-অধিকর্তা নীলম চৌধুরী এবং বেঙ্গালুরুর ডি কে নাগরাজুরাও বলেন, ‘‘এখানে ভাল কাজ হচ্ছে। কী ভাবে তা হচ্ছে তা জেনে আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে প্যাক হাউসে এসেছি।’’

তবে ফলন বাক্সবন্দি করা তো একেবারে শেষের কাজ। মুন্সিয়ানা দেখাতে হয় চাষের জমি থেকেই। উত্তর ২৪ পরগনার রবিউল যেমন ১২ বিঘে জমিতে ১০ কাঠা করে ভাগ করে শিম, পটল, কাঁকরোল, লাউ, কচু, পেঁপের মতো সব্জি চাষ করছেন। এক বিঘে জমিতে কাঁঠাল চাষ তো করছেনই। কয়েকটি কাঁঠালবাগান লিজে নিয়ে কর্মী রেখেছেন। ১৬ কাঠা জমিতে করছেন পেয়ারা চাষ। তাঁর কথায়, ‘‘আমি কৃষি প্রশিক্ষণ নিয়েছি। রাসায়নিক সার কম, গোবরের মতো জৈব সার বেশি ব্যবহার করি। কখনও কীটনাশক দিতে হলেও তা পরিমাণ মতো ব্যবহার করি।’’ নিজেই গাড়ি ভাড়া করে কিংবা রফতানিকারীদের পাঠানো গাড়িতে তিনি প্যাক হাউসে সব্জি-ফল পাঠিয়ে দেন।

উত্তর ২৪ পরগনা ছাড়াও নদিয়া, হুগলি, বর্ধমানের মতো চাষ-প্রধান জেলার সাড়ে পাঁচ হাজার চাষির কাছ থেকে ফল ও সব্জি কিনে নেন এই রফতানিকারীরা। ‘ইনটিগ্রেটেড প্যাক হাউসে’ দক্ষ কর্মীরা সেই ফল-সব্জি বাছাই ও পরিচর্যা করে বাক্সে ভরেন। সেই ফল-সব্জি পরীক্ষাগারে দেখেও নেওয়া হয়। প্রতি মাসে প্রায় ৮ কোটি টাকার (৫ লক্ষ কিলো) ফল ও সব্জি রাজ্য থেকে রফতানি হয় ইউরোপ, আরব-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের অধীন এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড প্রসেসড ফুড এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা অ্যাপেডা-র রাজ্য অধিকর্তা সি বি সিংহ বলেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকেরা উৎকৃষ্ট ফসল ফলাবেন। কোনও ফড়ে থাকবে না। রফতানিকারীরা সরাসরি সেই মাল কিনে উপযুক্ত প্যাক হাউসে বাক্সবন্দি করবেন। তার পরে রফতানি করা হবে। এই রাজ্য খুব ভাল ভাবে গোটা কাজটা করছে।’’

বেসরকারি প্যাক হাউসে ফলন বাক্সজাত করেই এই সাফল্য এসেছে। কিন্তু সুভাষনগরেই কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদিত ইনটিগ্রে‌টেড প্যাক হাউস রয়েছে। রাজ্য সরকারের উদাসীনতায় সেখানে ফল-সবজি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ। সেটির ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি উদ্যান পালন দফতরেও দরবার করেছিলেন রফতানিকারীরা। ফল না হওয়ায় গত বছর ১৫ ডিসেম্বর থেকে পাশেই একটি বেসরকারি প্যাক হাউসে তাঁরা ফল-সব্জি রাখতে শুরু করেন।

রাজ্যের ১৫টি রফতানি সংস্থার সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফ্রুটস এন্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক মৃণাল সিংহের আক্ষেপ, ‘‘বিদেশে রাজ্যের ফল-সব্জির কদর বাড়ছে। আমাদের উৎপাদন ও প্যাকিংয়ের প্রশংসা ভিন্ রাজ্যের অধিকর্তারাও করছেন। অথচ সরকারি প্যাক হাউস পড়ে নষ্ট হচ্ছে। বেশি টাকা খরচ করে বেসরকারি প্যাক হাউসে ফল-সব্জি রাখতে হচ্ছে আমাদের। রাজ্য সরকারকে বারবার জানিয়েও সুরাহা হচ্ছে না।’’

রাজ্যের উদ্যান পালন দফতরের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী এ সবের কিছুই জানেন না। সন্ধ্যায় তিনি নিজেই বলেন, ‘‘এ সব আমার জানা নেই।’’ সরকারি প্যাক হাউস চালু করার জন্য কেন্দ্রের কাছে বরাদ্দ টাকা চাওয়া হচ্ছে না কেন? গত এক বছরের বেশি সময় ধরে মন্ত্রী যা বলে এসেছেন, এ দিনও তা-ই বলেন— ‘‘আমরা এ নিয়ে আলোচনা করছি। নিজেরা চালাতে না পারলে ওই প্যাক হাউসটিও আমরা বেসরকারি সংস্থার হাতে দিয়ে দেব।’’ কেন্দ্রের অধীন প্যাক হাউস কী করে বেসরকারি হাতে দেওয়া সম্ভব, তার সদুত্তর অবশ্য মন্ত্রী দিতে পারেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE