বেজায় মুশকিলে বালিগঞ্জের মনোরমা বসু। বিকেলে ‘ডে কেয়ার’-এর ছুটির পরে ছেলেকে কী খেতে দেবেন, মাথায় ঢুকছে না। রাসবিহারীর বহুজাতিক রিটেল মলের কাউন্টারে দু’-মিনিটের চটজলদি নুডল্সের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি।
মনোরমার ছেলে পাভেল ক্লাস টুয়ে পড়ে। বুধবার অফিস থেকে বাড়ি ফেরার আগে মাসকাবারি তুলতে এসে সব কিছু ছাপিয়ে ‘ম্যাগি’ না-থাকাটাই মহিলাকে বেজায় অস্বস্তিতে রেখেছে। ‘মা-ছেলের সংসারে ম্যাগি নুডল্সই ‘লাইফলাইন!’— ক’দিন আগেই ফেসবুকে লিখেছিলেন মনোরমা।
সত্যিই তো! টিফিনে হোক বা সান্ধ্য জলখাবারে— ম্যাগি পেলে ছেলে কিছু চায় না। দিনভর অফিসে ধকলের পরে মায়েরও ইচ্ছে করে হেঁসেলটাকে বাদ রাখতে। তখন ম্যাগিই হয়ে ওঠে মুশকিল আসান।
এখন খোদ পরিত্রাতাই বিতর্কের ফাঁসে ফেঁসে যাওয়ায় মনোরমার মতো অনেকের মাথায় বাজ। খাতায়-কলমে ম্যাগি নুডল্স এখনও পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ হয়নি। কেরল বা দিল্লির পথে হেঁটে পশ্চিমবঙ্গ কোনও কড়া পদক্ষেপ করবে কি না, তা-ও পরিষ্কার নয়। কিন্তু শহর-মফস্সলের খুচরো বাজারে ম্যাগি-আতঙ্ক ইতিমধ্যে থাবা বসাতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি যাচাই করতে রাজ্য সরকারের তরফেও কিছুটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
রাজ্যের ক্রেতা-সুরক্ষামন্ত্রী সাধন পাণ্ডে যেমন বলেছেন, ‘‘ম্যাগির কিছু নমুনার মান যাচাই করতে কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছিল। রিপোর্ট পুরোপুরি হাতে আসেনি।’’ মন্ত্রীর বক্তব্য, রিপোর্ট এলে তা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
২০০২-এর ক্রেতা-সুরক্ষা আইনের ১২(১)ডি ধারা মোতাবেক কোনও সংস্থার বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান সরকারের রয়েছে। তবে সাধনবাবু তাড়াহুড়ো না-করে আটঘাট বেঁধে এগনোর পক্ষপাতী। ‘‘আমরা নিজেরা ব্যবস্থা নিতে পারি ঠিকই। কিন্তু আমি ব্যবসা বন্ধ করতে চাই না। কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’’ নবান্ন-সূত্রের খবর, তাতে অবশ্য ম্যাগির সার্বিক ছবিটা খুব ভাল বলা যায় না। সরকারের এক মুখপাত্রের কথায়, ‘‘নমুনার সব রিপোর্টকে সন্তোষজনক বলা যাচ্ছে না। বাজার থেকে আরও কিছু নমুনা জোগাড় করে পরীক্ষা হবে। তার রিপোর্ট দেখে সিদ্ধান্ত হবে।’’
রাজ্য সরকার আপাতত ‘ধীরে চলো’ নীতি নিলেও খুচরো বিক্রেতারা অনেকেই ম্যাগিকে কাউন্টার থেকে নির্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। বিগবাজার যাদের অন্তর্ভুক্ত, সেই ফিউচার গোষ্ঠী ইতিমধ্যে দেশে ম্যাগি বিক্রি বন্ধ করেছে। তাদের এক বিবৃতি এ দিন বলছে, ‘‘ক্রেতাদের উদ্বেগকে গুরুত্ব দিয়ে ম্যাগি নুডল্সকে আমাদের সব বিপণির তাক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট নির্দেশ এলে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।’
স্পেন্সর্স থেকে বিগবাজার, পাড়ার মুদির দোকান থেকে বাজারের মণিহারি দোকান— সর্বত্র ম্যাগির বিক্রিবাটায় পড়তির ছাপ। বাজারের সব্জি-মাছ থেকে রোজকার খাবার আরও কত দূষণের উৎস,সে সম্পর্কে অফিসে-পাড়ায় সরগরম আলোচনা। ম্যাগিভক্তদের কেউ কেউ এখনই হাল ছাড়তে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও সংখ্যায় তাঁরা নগণ্য। অনেকে ম্যাগির বদলে ‘ইনস্ট্যান্ট নুডল্সের অন্য কোনও ব্র্যান্ডের খোঁজ করছেন। হাইকোর্টের উকিল অর্পিতা চৌধুরী থেকে কলকাতার পুর-আধিকারিক রক্তিম গঙ্গোপাধ্যায়— বাড়ির ছোটদের মুখে ম্যাগি তুলে দিতে কারও হাত সরছে না। ধর্মতলার এক বেসরকারি অফিস-ক্যান্টিনে এ দিন সন্ধে পর্যন্ত ম্যাগির অর্ডার করেছিলেন সাকুল্যে এক জন! আগাম কিনে রাখা ম্যাগির প্যাকেটগুলো নিয়ে কী করা যায়, তা ভেবে ক্যান্টিন-মালিকের মাথায় হাত।
এই সার্বিক ম্যাগি-আতঙ্ককে বিশেষজ্ঞদের একাংশও ‘অমূলক’ হিসেবে উড়িয়ে দিতে নারাজ। পুষ্টিবিশারদ রেশমি রায়চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ, ‘‘ম্যাগির কিছু নমুনায় সিসার অস্তিত্ব বাদ দিলেও অন্য সমস্যা আছে। মোনো সোডিয়াম গ্লুকামেটে ভরপুর আজিনা মোতো রয়েছে ম্যাগিতে, যা মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর পক্ষে ক্ষতিকর।’’ তাঁর মতে, ম্যাগির প্রধান ভক্ত যারা, সেই বাচ্চাদের জন্যই এটা বেশি ভয়ের কারণ।
তাই বলে ম্যাগি খাওয়া বন্ধ করলেই আজিনা মোতোর বিপদ দূর হটবে, এমনটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না। শহরের এক চিনে রেস্তোরাঁর শেফ স্বীকার করছেন, চিনে রান্নায় সরাসরি আজিনা মোতো না-মেশালেও এ দেশের লোকের রুচিমাফিক ‘ফ্লেভার’ আনতে এমন কিছু মশলা ব্যবহার করা হয়, যাতে আজিনা মোতোর উপাদান থাকে। ‘‘তা বেশি মাত্রায় পেটে যাওয়া ভাল নয়।’’— জানাচ্ছেন তিনি।
বিদেশে অবশ্য চিনে রান্নায় এ সব উপাদান নিয়ে কড়াকড়ি রয়েছে। আর এত দিনে এ দেশের ঘুম ভাঙছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy