নোট বাতিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলাকালীন তৃণমূলের নেতা-সাংসদেরা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার নোটিস পেতে শুরু করতেই প্রতিহিংসার অভিযোগ সামনে এনেছিলেন তিনি। রোজ ভ্যালি-কাণ্ডে তাঁর দলের সাংসদ তাপস পাল গ্রেফতার হতে সেই অস্ত্রেই নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, নোট-কাণ্ডের ৫০ দিনে তাঁরা ফের আন্দোলনে নামবেন জেনেই কেন্দ্র এক জন সাংসদকে গ্রেফতার করে ভয় দেখাতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রীকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে শুক্রবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘পারলে আমার দলের সবাইকে গ্রেফতার করুক। আই ডোন্ট মাইন্ড! বরং, আমাকে গ্রেফতার করুন। কয়েক দিন বিশ্রাম পাই। সারা জীবনে এক দিনও ছুটি পাইনি। বরং, আমি কিছু বই-টই লিখতে পারি!’’
নোট বাতিলের ৫০ দিন পরে অর্থনীতি সামাল দিতে কেন্দ্র পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে বিরোধীদের দমন করতে প্রতিহিংসার রাস্তায় হাঁটছে বলে মমতার অভিযোগ। সেই সঙ্গেই তাঁর দাবি, চাপ সৃষ্টির জন্য তৃণমূলের কোনও সাংসদকে যে গ্রেফতার করা হতে পারে, তা তিনি জানতেন। মমতার কথায়, ‘‘আমি তো জানতাম। কেন জানব না! ওরা কী ভাবেন, এ দেশে আমাদের বন্ধুবান্ধব, চেনাশোনা অফিসার নেই? এই তো আমাদের কাছে সিবিআইয়ের কাগজ আছে। কাকে কাকে ধরবে, কী করবে, না করবে, সমস্ত আছে। এ তো সব প্রধানমন্ত্রীর দফতর আর বিজেপির দলীয় দফতর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘একটা সরকার আসার পরে দেশে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। জরুরি অবস্থা ভুলে যান। দেশ যখন পরাধীন ছিল, তখনও এই সন্ত্রাস কেউ দেখেনি!’’
বিজেপির ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’তে তাঁরা ভীত নন, এই
বার্তা দিতেই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ঘোষণা করেছেন, তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিবিআই ডাকলে তিনি ‘বীরের মতো’ যাবেন! আগে সুদীপবাবুকে সিবিআই দফতরে হাজির না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন মমতাই। মমতা শিবিরের ধারণা, তাপস পালের পরে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী রায়, এমনকী মমতার পরিবারের কোনও সদস্যকেও সিবিআইকে দিয়ে অভিযুক্ত করার চেষ্টা চলছে।
বিজেপি সূত্র বলছে, দু’মুখো রণকৌশল নিয়ে চলছে মোদী সরকার। এক দিকে মোদী-বিরোধী রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা ভেস্তে দেওয়া। অন্য দিকে চাপে রেখে মমতার সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসার চেষ্টা, তিনি যাতে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে দেশ জুড়ে যৌথ কর্মসূচি না নেন। শুধু মমতা নয়, উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী, মুলায়ম এমনকী ডিএমকে-এডিএমকের বহু নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে একই ভাবে তদন্ত চালানো হচ্ছে।
বিজেপির কৌশল, দুর্নীতির প্রশ্নে তৃণমূলকে কঠাগড়ায় তোলা, যাতে রাহুলও অদূর ভবিষ্যতে মমতাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাতে না পারেন। রাজ্য সভাপতি অধীর চৌধুরী বা বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানও দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে হাইকম্যাণ্ডের উপর চাপ দিতে পারবেন। তাতে লাভ বিজেপিরই। মমতা অবশ্য ঘরোয়া ভাবে বলছেন, ‘‘এটা বিজেপির ভুল রণনীতি। এতে আর কেউ ভয় পেতে পারেন, কিন্তু আমি পাই না। সিবিআইকে দিয়ে ওরা যতই চাপ দিক, নোট বাতিলের প্রতিবাদে আন্দোলনে আমরা থাকছিই।’’
মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের প্রতিহিংসার তত্ত্ব শুনে পাল্টা সরব হয়েছে বিরোধীরাও। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ যেমন মন্তব্য করেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী প্রতিহিংসার রাজনীতি করলে আপনিও (মুখ্যমন্ত্রী) জেলে থাকতেন! করলে আপনাকে দিল্লিতেই আটকানো হতো।’’ দিলীপবাবুর আরও সংযোজন, ‘‘৩ তারিখ সুদীপবাবু যাবেন। আর জেলের ভাত খাবেন!’’
তৃণমূল নেত্রী যে বলছেন নোট বাতিলের প্রতিবাদ করছেন বলেই কেন্দ্র প্রতিহিংসা চালাচ্ছে, সেই যুক্তিতেই কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলের আঁতাঁতের অভিযোগ ফের সামনে এনেছে বাম ও কংগ্রেস। বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী যেমন বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবাদ করলেন আর সিবিআই তথ্যপ্রমাণ হাতে পেয়ে গেল— এ রকম তো হতে পারে না! তার মানে সব কিছু হাতে নিয়েই সিবিআই এত দিন চুপ করে ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেই বোঝা যাচ্ছে, দু’পক্ষে এত দিন সমঝোতা ছিল!’’ মহম্মদ সেলিমও বলেছেন, তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা মুখ্যমন্ত্রী করলেও তাতে
আটকে না গিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা যেন সত্যের ‘গোড়া’ পর্যন্ত অনুসন্ধান করে। আর বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের বক্তব্য, ‘‘আবার এক সাংসদ গ্রেফতার হলেন। দলনেত্রী হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।’’
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই প্রধানমন্ত্রীকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘‘এতে কিছু যায় আসে না মোদীবাবু। আপনি সব সাংসদকে গ্রেফতার করুন। কবে কবে করবেন বলুন, আপনাদের ডাকতেও হবে না, তাঁরা গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘নোট-কাণ্ড নিয়ে মানুষের আন্দোলন চলবে। ওদের (রোজ ভ্যালির) চ্যানেল করার অধিকার কে দিয়েছে? এখনও তো চ্যানেল চলছে। কোনও সাংসদ যদি চ্যানেলের আতিথেয়তা নেন, অনুষ্ঠান করতে যান— তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য সিবিআই-কে বলছে। ভয় দেখাতে চাইছে।’’
ধৃত সাংসদ তাপসবাবুর পক্ষ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সওয়াল, সব চিত্রতারকা বা খেলোয়াড়রাই তো কোথাও না কোথাও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার বা অধিকর্তা। অমিতাভ বচ্চন গুজরাতের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার, শাহরুখ খান বাংলার। মমতার কথায়, ‘‘সহারা তো ক্রিকেট থেকে ফুটবল, সব স্পনসর করেছে! তখন সরকার কী করছিল?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy