১৯৯৩ সালের ৩১ অক্টোবর।
হুগলির ভদ্রেশ্বরে ভিক্টোরিয়া জুটমিলের নিখোঁজ ঠিকাকর্মী ভিখারি পাসোয়ানকে নিয়ে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল।
শুধু সিঙ্গুর পর্ব নয়। সেই সময় চটকল অধ্যুষিত তেলেনিপাড়ার (যেখানে পরিবার নিয়ে থাকতেন ভিখারি) মতো এলাকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পা রাখার উপরে দাঁড়ি টেনেছিলেন স্বয়ং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
বস্তুত ঘটনাটা ছিল এরকম, স্থানীয় প্রশাসন হুগলির তৎকালীন ডাকাবুকো যুব কংগ্রেস নেতা আকবর আলি খন্দকারকে কোনও ঝামেলায় না জড়ানোর শর্তে তেলেনিপাড়ায় ঢোকার অনুমতি দিয়েছিল। মমতাও যে সেখানে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাবেন তা আগেভাগেই জেনে মাথায় হাত পড়েছিল প্রশাসনের। আর প্রমাদ গুনেছিলেন জ্যোতিবাবু। কী হতে যাচ্ছে, তা সম্ভবত আঁচ করেই হুগলির তৎকালীন পুলিশ সুপার সন্ধি মুখোপাধ্যায়কে তিনি নির্দেশ দেন, কোনও শর্তেই যুব কংগ্রেস নেত্রীকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন নির্দেশ যখন জানতে পারলেন পুলিশের কর্তারা, ততক্ষণে তেলেনিপাড়ার উদ্দেশে কালীঘাটের বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছেন মমতা। শুধু তাই নয়, কাছাকাছি শেওড়াফুলিতে পৌঁছে যাওয়ার খবর চলে আসে পুলিশের কাছে। অতঃপর বিপাকে পড়ে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে চন্দননগরের তৎকালীন এসডিপিও এন রমেশবাবু স্থানীয় জেলা নেতা আকবরকে বিষয়টি জানান। এই আশায় যদি কোনওভাবে মমতাকে বিরত করা যায়। কিন্তু দিদির ‘মুড’ সম্পর্কে ভালমত ওয়াকিবহাল আকবর প্রথমে পিছিয়ে আসেন। কেন না, তিনি জানতেন একবার যদি কোনওভাবে জেলা তথা রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের মনোভাব দিদি বুঝে যান তা হলে লঙ্কাকাণ্ড বাধবে।
হাল না ছেড়ে দিদিকে সামলানোর জন্য আকবরের উপরে প্রশাসনের পীড়াপিড়ি চলতে থাকে। কারণ তখন একেবারে রোখা মেজাজ মমতার ডাকে শ’য়ে শ’য়ে ছেলে এক কথায় রাস্তায় নামে। তাই পুলিশ যদি মমতাকে আটকাতে যায় তাহলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। ইতিমধ্যে তেলেনিপাড়ায় মমতার আসার কথা জেনে শুনে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ভিড় করতে শুরু করেছেন। প্রশাসনের অবস্থা তখন শাঁখের করাত। একদিকে তেলেনিপাড়ার মতো মিশ্রভাষি এলাকায় মমতা যেতে না পারলে পরিস্থিতি ঘোরালো হবে। অন্যদিকে যেখানেই মমতাকে আটকানো হবে সেখানেই ভিড় হবে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ সিদ্ধান্ত নেয়, এমন জায়গায় মমতাকে আটকানো হবে যাতে ভিন্ন দুটি জমায়েত একসঙ্গে মিলতে না পারে। কারণ সে ক্ষেত্রে যুব কংগ্রেস কর্মীরা একসঙ্গে হলে মারমুখী হয়ে পড়তে পারেন।
সাতপাঁচ আঁচ করে পুলিশ মমতাকে তেলেনিপাড়া থেকে বহুদূরে বৈদ্যবাটি রেলগেটের আগেই আটকে দেয়। নাছোড় মামতা প্রতিবাদে জিটি রোডে অবরোধে বসে পড়েন। তা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বিরোধ বেধে যায়। মূলত এ দিনের ঘটনার পর থেকেই সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিক ভাবে ঠাঁই করে নেয় ভিখারি ইস্যু। ভিখারি-র নিখোঁজ রহস্যের সমাধানে সিবিআই তদন্ত দাবি করেন মমতা। প্রবল আন্দোলনের চাপে এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত বামফ্রন্ট সরকার সিবিআইকে তদন্তে ডাকে।
কিন্তু কী হয়েছিল ভিখারির?
ভিক্টোরিয়া চটকলে এক পদস্থ কর্তাকে মারধর করে শ্রমিকেরা। সেই ঘটনা সামাল দিতে পুলিশ গেলে এক পুলিশ কর্মীর মাথা ফাটে। মারমুখী চটকল শ্রমিকদের হাতে বেধড়ক মার খান মিলের কর্তারা। তেলেনিপাড়ার মতো স্পর্শকাতর এলাকায় পরিস্থিতি আঁচ করে তৎকালীন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হরমনপ্রীত সিংহ সেখানে যান। কিন্তু ভারী সংখ্যায় পুলিশ দেখে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে শ্রমিকেরা। ছোড়া শুরু হয় ইট,পাটকেল বোমা, কাচের বোতল। গোলমালে হঠাৎ দলছুট হয়ে যাওয়া হরমনপ্রীত সিংহের দেহরক্ষী বলরাম সিংহকে পিটিয়ে মারে ক্ষিপ্ত জনতা। পুলিশ কর্মীর মৃত্যুতে কারফিউ জারি করা হয় তেলেনিপাড়ায়। ঠেকে নিয়মিত মদ খাওয়ার অভ্যাস ছিল ভিখারির। পুলিশের সঙ্গেও তাঁর সখ্যতা ছিল। অনেক সময় পুলিশকে তিনি এলাকার খবর দিতেন। আর সেই বিশ্বাসেই পুলিশি ধরপাকড়ের ভয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যরা চলে গেলেও ভিখারি এলাকা ছাড়েননি। পুলিশ কর্মীকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় তাই ডেকে পাঠাতেই অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কাছে হাজির হয়ে যান ভিখারি। এলাকার পুলিশ কর্মীকে পিটিয়ে মারার সময় কে কে তাতে যোগ দিয়েছিল ভিখারির কাছে তা জানতে চান পুলিশ কর্তা। কিন্তু কিছু জানেন না বলায়, ভিখারির উপরে চটে যান হরমনপ্রীত।
বাড়ি ফেরার পর ওই রাতেই ভিখারিকে বাড়ি থেকে মারতে মারতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। তারপর থেকেই নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। তদন্তে জানা গিয়েছিল, পুলিশের বেধড়ক মারে তলপেটে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে চুঁচুড়ার ধরমপুর ফাঁড়িতেই ভিখারির মৃত্যু হয়। এও জানা যায়, দাদপুর এবং পোলবা থানার পুলিশ ভিখারির দেহের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় একশ্রণির পুলিশ কর্মী মাঝিদের সঙ্গে যোগসাজশে ভিখারির দেহ তারে জড়িয়ে ইট বেঁধে বাঁশবেড়িয়ার কাছে ওই রাতে গঙ্গায় ফেলে দেয়। এ নিয়ে কোনও প্রামাণ্য তথ্য না পাওয়া গেলেও পুলিশেরই নানা মহল থেকে ঠারেঠোরে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করা হয়।
সিবিআইয়ের তদন্ত সেই সময় রাজ্য রাজনীতিতে যথেষ্ট আলোড়ন তুললেও পরিণতি পায়নি ভিখারি মামলা। ক্রমে কালের আড়ালে চলে যান ভিখারি।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy