এক ধাক্কায় তফসিলি উন্নয়নে বরাদ্দ কমে গেল অর্ধেকেরও বেশি। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার একযোগে বরাদ্দ ছেঁটেছে টাকা খরচ না করতে পারার অভিযোগ তুলে। প্রশাসন অবশ্য আঙুল তুলছে সরকারের দিকেই। তাদের অভিযোগ সঠিক সময়ে টাকা এসে পৌঁছয়ই না, তা হলে নির্দিষ্ট সময়ে খরচ হবে কী করে?
২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে তফসিলি উন্নয়ন খাতে টাকা সম্প্রতি এসে পৌঁছেছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের হাতে। আর তা দেখে কার্যত অবাক প্রশাসনিক কর্তারা। গত আর্থিক বছরের জন্য জেলা প্রশাসন সেচ, পানীয় জল, আইসিডিএস কেন্দ্র, বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস তৈরি-সহ প্রায় ৫৯৪টি প্রকল্পের রিপোর্ট তৈরি করেছিল। প্রায় সাড়ে ৫২ কোটি টাকার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু মঞ্জুর হয়ে এসেছে মাত্র ৬ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা।
প্রশাসনিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত সাত বছরে বহু টাকা পেয়েছে জেলা প্রশাসন তফসিলি উন্নয়ন খাতে। এমনকী প্রতি বছরই বেড়েছে বরাদ্দের পরিমাণ। অথচ বেশিরভাগ বছরেই খরচ হয়নি অর্ধেক টাকাও। হিসাব বলছে মাত্র তিন বছর ১০০ শতাংশ টাকা খরচ করা সম্ভব হয়েছে। বাকি বছর গুলিতে কোনও বার খরচ হয়েছে ৮০ শতাংশ, কোনও ৫০ শতাংশ। ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে প্রাপ্ত টাকার ৫০ শতাংশ আজও খরচ করা যায়নি বলে সূত্রের খবর।
সে ক্ষেত্রে মূলত বিগত বছরগুলিতে পাওয়া টাকা সঠিক সময়ে খরচ করতে না পারাকেই হাতিয়ার করেছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়েই। তারই ফলে বরাদ্দও ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন টাকা খরচ করা যায়নি? জেলা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের ব্যাখ্যা, টাকা পেতে প্রতি বছরই দেরি হয়। আর্থিক বছর শেষ হওয়ার সময় টাকা এসে পৌঁছয়। উদাহরণ তুলে তারা দেখিয়েছেন গত আর্থিক বছরের টাকা যেমন মার্চ মাসের শেষ দিকে ঢুকল। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে টাকা খরচ করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে না হয় হল। কিন্তু হিসাব যে বলছে চার-পাঁচ বছরের পুরনো টাকাও খরচ করা যায়নি। নির্দিষ্ট সময়ে না খরচ করা যাক পরে তো করা যেত। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলাশাসক (পঞ্চায়েত) সুশান্ত চক্রবর্তীর সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘আমরা একটা পরিকল্পনা করে পাঠাই। সরকার যতটা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে ততটাই দেয়।’’ তবে কাজ হয়নি বলে টাকা মেলেনি, এ কথা মানতে নারাজ তিনি।
কারণ যাই হোক এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষজন। লোধা শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বলাই নায়েক বলেন, ‘‘এমনিতেই আমরা পিছিয়ে রয়েছি। টাকা পেলেও সরকার প্রকৃত উন্নয়ন করার সদিচ্ছা দেখায়নি। এবার বরাদ্দ না মিললে তো কিছুই হবে না।’’ মাঝি মাডওয়া জুয়ান গাঁওতা-র সাধারণ সম্পাদক প্রবীর মুর্মুর কথায়, “প্রতি বছরই শুনি টাকা ফেরত্ যাচ্ছে, খরচ হচ্ছে না। অথচ, আদিবাসীরা পিছিয়ে যাচ্ছে। এ বার তো শুনলাম বেশি টাকা আসেনি। উন্নয়ন না হলে আন্দোলন ছাড়া পথ নেই।’’
তফসিলিদের উন্নয়নে বিভিন্ন খাতে টাকা পায় জেলা। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় যেহেতু তফসিলি মানুষের বসবাস বেশি, এই জেলাতেই লোধাদের মতো আদিম জনজাতিও রয়েছে, তাই এই জেলায় তপসিলি উন্নয়নে গুরুত্ব পেয়েছে। ২০০৬-০৭ আর্থিক বছরেও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তপসিলি উন্নয়নে প্রায় আড়াই কোটি টাকা পেয়েছিল। পরের বছর কয়েকগুণ বেড়ে সাড়ে সাত কোটিরও বেশি বরাদ্দ পায়। এভাবে প্রতি বছরই বরাদ্দ বেড়েছে। কোনও বছর ১০ কোটি টাকা মিলেছে তো কোনও বছর প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
কিন্তু প্রতি বছরই নির্দিষ্ট সময়ে খরচ করা তো দূরের কথা, বছরের পর বছর টাকা পড়ে থাকলেও তা খরচে করতে পারেনি প্রশাসন। তা লোধাদের বাড়ি তৈরি হোক বা ফলের বাগান, স্কুলের ছাত্রবাস তৈরি হোক পানীয় জলের ব্যবস্থা—বহু ক্ষেত্রে কাজই শুরু হয়নি! পরবর্তীকালে কাজ করতে গিয়েও সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। কারণ, প্রতি বছরই মূল্য বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে। এক বছরের টাকায় ২-৩ বছর পর কাজ করলে সে কাজের যে গুণগত মান ঠিক রাখা মুশকিল তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তা সত্ত্বেও প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণে কাজ হচ্ছে ঢিমে তালেই। ২০১৩-১৪ অর্থ বর্ষের পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ৯৭টি প্রকল্পের মধ্যে এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে মাত্র ২৬টি প্রকল্প। ৭১টি প্রকল্পের কাজই নাকি চলছে! মঞ্জুর হওয়া প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা! তারই মাসুল দিতে হল জেলাকে। প্রশাসনিক কর্তাদের অবশ্য দাবি, ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে সে জন্য পদক্ষেপ করা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy