ভোলানাথের মৃতদেহ আসার পর বাড়ির সামনে ছেলেকে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তাঁর স্ত্রী। নিজস্ব চিত্র
নাম ছিল। প্রাণ ছিল। ছিলেন তরতাজা এক যুবক। কিন্তু হাসপাতালের মর্গে সেই যুবককে তাঁর মা যখন শনাক্ত করলেন, তখন তিনি শুধু একটা নম্বর মাত্র— এ৩বিনজি! ভগবানপুরের সেই যুবক শিবশঙ্কর দাসের মৃতদেহ নিয়ে সোমবার বাড়ি ফিরলেন তাঁর পরিজন।
গত শুক্রবার ওড়িশার বাহানাগা এলাকায় করমণ্ডল, যশবন্তপুর এবং মালগাড়ির দুর্ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন ভগবানপুরের গোপালপুর গ্রামের বছর সাতাশের শিবশঙ্কর। পেশায় রাঁধুনি শিবশঙ্কর ওড়িশার জাজপুর কাজ যাচ্ছিলেন গত শুক্রবার। করমণ্ডলের অসরক্ষিত কামরায় উঠেছিলেন খড়্গপুর থেকে। ওই দুর্ঘটনার পরই তাঁর পরিজন ওড়িশা যান। গত দু’দিনে দুর্ঘটনাস্থল, হাসপাতালে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন তাঁরা। শেষে অজ্ঞাত পরিচয় মৃতদেহগুলি শনাক্ত করার জন্য পরিজনদের ডিএনএ পরীক্ষা করানো হয়। ওই পরীক্ষার জন্যই রবিবার রাতে ভুবনেশ্বরের এইএমস হাসপাতালে যান শিবশঙ্করের মা নিয়তি দাস। তবে সেই পরীক্ষার আগেই ভুবনেশ্বর সুমো হাসপাতালের মর্গে ‘এ৩বিনজি’ নম্বর মৃতদেহটিকে নিজের ছেলে বলে শনাক্ত করেন নিয়তি।
সোমবার সকালে ভগবানপুরে গুড়গ্রামে শিবশঙ্করের মরদেহ আনা হয়। দুপুরে গ্রামের শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। শিবশঙ্করের মামা লক্ষ্মীকান্ত পাল বলেন, ‘‘পরিবারের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিতে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিল ছেলেটা। জলজ্যান্ত ছেলেটা এভাবেই একটা নম্বর হয়ে বাড়িতে ফিরবে স্বপ্নেও ভাবিনি। সব শেষ হয়ে গেল।’’ এদিন বাড়িতে গিয়ে শিবশঙ্করকে শ্রদ্ধা জানান বিজেপি ও তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব। ওই ট্রেন দুর্ঘটনাতেই এগরার গোপালপুরের সমীর মান্না এবং পটাশপুরের যুবক মানস মাইতি নিখোঁজ হয়েছেন। এ দিনও তাঁদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
গত শুক্রবার ওড়িশার বাহানাগা এলাকায় করমণ্ডল, যশবন্তপুর এবং মালগাড়ির দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৩০০ ছুঁতে চলেছে। সোমবার বিকাল পর্যন্ত জেলা প্রশাসনিক তথ্য অনুসারে এর মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুরেই রয়েছেন ১২ জন। এই জেলার আহতের সংখ্যাও বেড়ে হয়েছে ১৩৪। শিবশঙ্করের মতোই অন্য এলাকার মৃতদের দেহ এদিন ওড়িশার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এলাকায় নিয়ে ফিরেছেন পরিজন। দুর্ঘটনার তিন দিন পর এ দিন জেলায় এসে পৌঁছেছে খেজুরির পাঁচ বাসিন্দার দেহও। দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসে ছিলেন খেজুরির বোগা গ্রামের চার পরিযায়ী শ্রমিক শঙ্কর প্রধান, সুমন প্রধান, নন্দন প্রধান এবং ভোলানাথ গিরি। এ দিন ভোরে তাঁদের মৃতদেহ নিয়ে আসা হয় এবং শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত আরেক যুবক রাজীব ডাকুয়ার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ শ্যামপুর গ্রামে।
মৃতদেহগুলি ফিরে আসার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁদের পরিবারের লোকজন। এক দুর্ঘটনায় একই পাড়ার চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় কার্যত নিস্তব্ধ গোটা বোগা গ্রামের। এ দিন অনেকের বাড়িতেই হাঁড়িও চড়েনি। মৃত নন্দনের দাদা চন্দন প্রধান বলছেন, "এলাকায় কাজ জোটে না। সংসার চালানোর মত কাজ পাওয়া যায় না। আমিও দীর্ঘদিন চেন্নাইতে কাজ করি। বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অত দূরে গিয়ে আমার মতো ভাইকেও কাজ করতে যেতে হয়েছিল।’’ পাঁচ যুবকের মৃতদেহ আসার পর তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতা ও কর্মীরা। মৃত যুবকদের পরিবারে পাশে থাকার আশ্বাস দেন তৃণমূল পরিচালিত খেজুরি-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অসীম মণ্ডল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy