যত্রতত্র এভাবেই পড়ে রয়েছে সমাধিস্থলের ভগ্নাবশেষ। —নিজস্ব চিত্র।
দিঘা তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। স্বাস্থ্যোদ্ধার স্থল হিসেবে তখন বীরকূলের নাম। আর ছিল খেজুরি। বাংলার অন্যতম বন্দর তখন। বন্দর ছাড়াও খেজুরির আরেক বিষয়ে সুনাম ছিল। এটিও ছিল বিদেশিদের পছন্দের স্বাস্থ্যনিবাস। বন্দর ও স্বাস্থ্যনিবাস একযোগে হওয়ায় নাবিক, বণিক, ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারে আসা বিদেশিদের আনাগোনা লেগেই থাকত খেজুরিতে। কিন্তু সকলের ফেরা হত না। মারা যেতেন অনেকে। তাঁদের সমাধি দেওয়া হত স্বাস্থ্যনিবাসের মাটিতে। খেজুরির হারিয়ে যাওয়া গৌরবের সাক্ষ্য দেয় বিদেশিদের এই সমাধিগুলো। কিন্তু বর্তমানে ইউরোপীয়দের সমাধিস্থলের অবস্থা করুণ। জঙ্গল আর বটগাছে ঢেকে গিয়েছে। চুরি হয়ে যাচ্ছে ফলক। ঐতিহাসিক এই সমাধিস্থল সংরক্ষণের দাবি তুললেন ইতিহাসপ্রিয়রা।
দার্জিলিং, পুরী, গোপালপুর তখনও সাহেবদের স্বাস্থ্যনিবাস কেন্দ্রে পরিণত হয়নি। খেজুরি ছিল বিদেশি বণিক ও নাবিকদের প্রধান বিশ্রাম ও আড্ডার জায়গা। ফলে এখানে অনেক হোটেল ও ট্যাভার্ন গড়ে উঠেছিল। ছিল বড় বড় ডাকবাংলো, বন্দর, অফিস, এজেন্ট হাউস। কাঁথি, হিজলি, বীরকূলের মতো খেজুরি ছিল স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার কেন্দ্র। জমজমাট এই বন্দর-শহর তথা স্বাস্থ্যনিবাস সাক্ষী ছিল অনেক বিষণ্ণ ইতিহাসের। ঐতিহাসিক মহেন্দ্রনাথ করণ এমেলিয়া ম্যাক্সওয়েলের মৃত্যুর কথা লিখেছেন। ১৮২২ সালের ২৬ জুলাই খেজুরিতে মারা যান এমেলিয়া। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৮ বছর ২ মাস। দিনাজপুরের ম্যাজিস্ট্রেট এডওয়ার্ড ম্যাক্সওয়েল স্ত্রী এমেলিয়ার স্বাস্থ্য উদ্ধারে খেজুরিতে এসেছিলেন। এখানকার সমাধিস্থলেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। শোকগ্রস্ত স্বামী এক এপিটাফে স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা ব্যক্ত করেন। তারই কয়েকটি পঙক্তি, ‘হোয়েন সরো উইপস ওভার ভার্চুস সেক্রেড ডাস্ট/আওয়ার টিয়ার্স বিকাম আস অ্যান্ড আওয়ার গ্রিফ ইজ জাস্ট’। ফলকটি উধাও এখন।
স্থানীয় সূত্রে খবর, খেজুরিতে ইউরোপীয় সমাধিস্থলে মোট ৩২টি সমাধি ছিল। কিন্তু, গত বছর ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর সমাধিস্থল থেকে সব ফলক উধাও হয়ে গিয়েছে। বেশকিছু সমাধি ফলক স্থানীয়েরা বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন বলেও অভিযোগ। একটি নামের ফলক খেজুরি থানায় রয়েছে বলেও খবর মিলেছে। ইতিমধ্যে খেজুরির এইসব পুরনো ঐতিহ্যকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হেরিটেজ ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবু, তার আগে ডাকঘর, ইউরোপীয়দের সমাধিস্থল সংরক্ষণের দাবি উঠেছে। খেজুরি হেরিটেজ সুরক্ষা সমিতির সুদর্শন সেন বলেন, ‘‘দেশের প্রথম ডাকঘর-সহ দেশের প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য সমাধিস্থল সংরক্ষণ করা দরকার। তার জন্য প্রশাসনের সব স্তরে জানানো হবে।’’ এ প্রসঙ্গে খেজুরি ২ ব্লকের বিডিও ত্রিভুবন নাথ বলেন, ‘‘সমাধি থেকে নামের যে সব ফলক উধাও হয়ে গিয়েছে, সেগুলো উদ্ধারের জন্য পুলিশের সঙ্গে কথা বলব।’’
সমাধিস্থল স্বজন হারানোর স্মৃতি জাগায়। কিন্তু এমেলিয়াদের সমাধি খেজুরির অতীত গৌরবের কথাও স্মরণ করায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy