Advertisement
১৯ মে ২০২৪

নেতাদের সিদ্ধান্তেই দখল স্কুলের জমি

ফুটপাথ জুড়ে ছিল দোকান আর ক্লাবঘর। মাস কয়েক আগে রাস্তা সংস্কারের জন্য সে সব বেআইনি দখল উচ্ছেদ করেছিল প্রশাসন। কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েত ও শাসক তৃণমূলের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন ওই সব দোকান মালিকদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে।

স্কুলের জমিতেই তৈরি হয়েছে সারি সারি দোকান। (ডান দিকে) দিব্যি চলে বিক্রি বাটা। — নিজস্ব চিত্র

স্কুলের জমিতেই তৈরি হয়েছে সারি সারি দোকান। (ডান দিকে) দিব্যি চলে বিক্রি বাটা। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
চাঁদড়া শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:২২
Share: Save:

ফুটপাথ জুড়ে ছিল দোকান আর ক্লাবঘর। মাস কয়েক আগে রাস্তা সংস্কারের জন্য সে সব বেআইনি দখল উচ্ছেদ করেছিল প্রশাসন। কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েত ও শাসক তৃণমূলের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন ওই সব দোকান মালিকদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে। তাও স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের মাঠে।

মেদিনীপুর শহরের কোতওয়ালি থানার চাঁদড়া এলাকার ঘটনা। চাঁদড়া প্রাথমিক স্কুলের জমি দখল করে গজিয়ে উঠেছে দোকানপাট, এমনকী ক্লাব ঘরও। এ বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। শুক্রবার সেই মামলায় হাইকোর্ট রীতিমতো ভর্ৎসনা করে রাজ্য সরকারকে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিশীথা মাত্রে সরকারি কৌঁশুলিকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘লেখাপড়ার কি দরকার নেই? স্কুল কি তুলে দিতে চান আপনারা? স্কুলের জমিতে দোকান তৈরি হবে? ক্লাব হবে? পড়ুয়াদের মনে এর কী প্রভাব পড়বে জানেন?’’

শনিবার এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, প্রায় ৩৭ একর জমির মাঝখানে একটি ছোট্ট বাড়ি। সেখানে আগে স্কুল বসত। পরে পিছনের দিকে একটি একতলা বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এখন স্কুল চলে সেখানেই। তার পিছনে রয়েছে রান্নাঘর। আর একদিকে রয়েছে সিআরসি (ক্লাস্টার রিসোর্স কোঅর্ডিনেটরস) এবং প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি করে ঘর।

সামনের খেলার মাঠ। তারই একদিকে দোকানঘর ও ক্লাব গজিয়ে উঠেছে। সেখানে রীতিমতো ক্রেতাদের ভিড়। ক্লাসঘর থেকেই বাইরের লোকজনের আনাগোনা দেখা যায়। ছাত্রছাত্রীরা যে মন বসাতে পারে না তা একপ্রকার স্বীকারই করে নিলেন এক শিক্ষক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘‘টিফিনে ওরা দোকানে চলে যায়। তার পর জানালা দিয়ে দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকে। বকে ধমকেও কাজ হয় না। ওরা তো ছোট।’’

ক্লাবের ঘরটি তৈরি হলেও এখনও সেখানে আড্ডা জমে না বলে দাবি করেছেন শিক্ষকদের একাংশ। কিন্তু সকাল থেকে যদিও আনাগোনা শুরু হয় ওই ক্লাব ঘরে তবে স্কুলের আর কোনও গোপনীয়তাই থাকবে না।

কিন্তু স্কুলের জমিতে পুনর্বাসন দেওয়া হবে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন কেন নেতারা?

মেদিনীপুর সদর পঞ্চায়েত সমিতির বন ও ভূমি স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ, তৃণমূলের সোমনাথ দে-র সাফ কথা, “যে জমিতে দোকান ঘর বা ক্লাব রয়েছে সেটি আদৌ স্কুলের জমি কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সকলে মিলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্কুলের তো কোনও সমস্যা হয়নি। কারা, কোন স্বার্থে মামলা করল জানি না!’’ তবে অনেক বেশি সংযমী চাঁদড়া পঞ্চায়েত প্রধান তারক বেরা। তিনি বলেন, “বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করব না।”

প্রাথমিক স্কুলটি চাঁদড়া বাজার এলাকায়। স্কুলের দু’দিকে দু’টি রাস্তা। একটি গিয়েছে ধেড়ুয়া হয়ে ঝাড়গ্রামে। অন্যটি পিরাকাটার দিকে। দু’টি রাস্তার ফুটপাথই দখল হয়ে গিয়েছিল। সেখানেই ছিল ওই ক্লাব ঘর এবং দোকানগুলি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন পিরাকাটা যাওয়ার রাস্তাটির অবস্থা এমনই হয়েছিল যে প্রতিদিন কোনও না কোনও দুর্ঘটনা ঘটত। তাই স্থানীয়রা বার বার দিবা তুলেছিলেন রাস্তা সংস্কারের। সেই সংস্কারে হাত দিয়েই প্রসাশনকে উচ্ছেদ করতে হয়েছিল ওই দোকানগুলি।

কিন্তু যখন পুনর্বাসনের জন্য স্কুলের মাঠকে বেছে নেওয়া হল তখন কেন প্রতিবাদ করেননি স্কুল কর্তৃপক্ষ?

স্কুলের টিচার-ইন-চার্জ সুপ্রিয় মণ্ডলের জবাব, “জমি সংক্রান্ত তথ্য নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদই জমি সংক্রান্ত বিষয় দেখে।”

জমি স্কুলের কিনা তা নিয়ে বার বার মাপজোক করে গিয়েছে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর। কিন্তু রিপোর্ট জমা পড়েনি। শুক্রবার হাইকোর্টেও সরকারি কৌঁশুলি বলেছিলেন, ‘‘ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক এখনও এ নিয়ে রিপোর্ট দেননি।’’

কিন্তু বার বার মাপজোক করেও কেন রিপোর্ট দিতে পারেননি? ‘বিচারাধীন বিষয়’ বলে দায় এড়িয়েছেন মেদিনীপুরের ব্লক ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিক শৈবাল সেনগুপ্ত। তবে স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, চেষ্টা করেও প্রমাণ করা যাচ্ছে না যে, দোকানঘরগুলি স্কুলের বাইরে। তাই চূড়ান্ত রিপোর্ট দিতে পারেনি দফতর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলেরই এক স্থানীয় নেতা বলেন, “স্কুলের মাঠে দোকান তৈরি ঠিক হয়নি। কিন্তু দলে আমরা সংখ্যালঘু। তাই আমাদের কথা তো চলে না।”

তবে বিচারাধীন বিষয়েও আত্মবিশ্বাস অগাধ সোমনাথ দে-র। তাঁর স্পষ্ট জবাব, “মাপ হতে দিন না। দেখবেন ওই জমি স্কুলের নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

School Land Occupied
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE