শোকার্ত: কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মৃতের স্ত্রী আশালতাদেবী। তাঁকে সান্তনা দিচ্ছেন এক পড়শি।
অস্বাভাবিক মৃত্যু হল এক আলু চাষির।
গত সোমবার দিলীপ হাতি (৫১) নামে ওই চাষি তাঁর নিজের জমিতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঘটনার পরই তাঁকে চন্দ্রকোনা গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করান প্রতিবেশীরা। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে পাঠানো হয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। বুধবার সেখানে দিলীপবাবুর মৃত্যু হয়। পুলিশের অনুমান, কীটনাশক খেয়েছিলেন।
মৃতের স্ত্রী আশালতা হাতি বলেন, “এ বার আলুতে দাম না থাকায় ক’দিন ধরেই মনমরা হয়ে ছিলেন আমার স্বামী। দাম ওঠেনি বলে এখনও মাঠেই আলু পড়ে রয়েছে। চাষের জন্য এবং অন্য কারণে ধারদেনাও হয়েছিল। প্রতিদিনই পাওনাদার বাড়িতে আসছিলেন।’’ তাঁর দাবি, ঋণের ভাবনায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলেন তাঁর স্বামীকে। মৃতের ছেলে তন্ময় হাতিও দাবি করেন, “গত বছর আমার বাবা এক গাড়ি আলু হিমঘরে রেখেছিলেন। বিক্রির সময় খরচ ওঠেনি। এ বারেও আলুর দাম নেই। সে জন্যই আত্মহত্যা করতে
বাধ্য হয়েছেন।”
চন্দ্রকোনা থানার ঝাঁকরা সংলগ্ন ভাটপাড়া গ্রামে বাড়ি দিলীপ হাতির। সামান্য কিছু জমিতে নিজে চাষবাস করতেন। সেই সঙ্গে পাইকারি আলু কিনে তা বিভিন্ন হাটে-বাজারে বিক্রিও করতেন। সম্প্রতি একটি পিকআপ ভ্যানও কিনেছিলেন ব্যাঙ্ক এবং অন্যের কাছে ধার করে। কিন্তু সে গাড়িতে একাধিক বার গাড়িটি দুঘর্টনা হয়। ফলে কিস্তির টাকা শোধ করা তো দূরের কথা, নতুন করে আরও দেনা করতে হয়েছিল। স্ত্রী ও পুত্রবধূর সোনার গয়না বন্ধক রেখে মেরামত করেছিলেন গাড়িটি।
স্থানীয় সূত্রের খবর, দিলীপবাবুর আগে বিঘা আষ্টেক জমি ছিল। বেশির ভাগটাই বিক্রি করে দিয়েছিলেন দেনার দায়ে। তাঁর দুই ছেলেও তেমন কোনও কাজকর্ম করেন না। মাঝে মধ্যে বাবার সঙ্গে হাটে আলু বিক্রি করতে যেতেন। ইদানীং অবশ্য তাঁরা মজুরিও খাটতেন। দিলীপবাবুও শুরু করেছিলেন ভাগ চাষ।
মৃত দিলীপ হাতি।
আশলতাদেবী বলছিলেন, “এত দেনা কেন হয়েছিল, আমরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। উনি পাওনাদারদের বলতেন আলু তুলে সবাইকে শোধ করে দেবেন। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।” দিলীপবাবুর ছোট ছেলে হারাধন বলেন, “এ বার বাবা দেড় বিঘা জমিতে আলু লাগিয়েছিলেন। আমরা চাষ করতেই নিষেধ করেছিলাম। শোনেননি। উল্টে অন্যের জমিও ভাগে চাষ করেছিলেন। একে দেনা সঙ্গে নতুন চাষেও খরচ হয়েছিল অনেক। দামও নেই। সব মিলিয়ে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন।”
এ বছর এমনিতেই আলুর দাম উঠছে না। কৃষি দফতর সূত্রেরই খবর, জেলায় এখনও প্রায় ৬০ শতাংশ আলু মাঠেই পড়ে রয়েছে। তার উপর বুধবার থেকে আকাশের মুখ ভার। অল্প অল্প বৃষ্টিও হচ্ছে। তাতে আলুর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
গত বছর আলুর মরসুমেই পুরোন ৫০০ এবং ১০০০ টাকা বাতিল করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে চাষ কী ভাবে হবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন চাষিরা। তবে সে যাত্রায় এগিয়ে এসেছিলেন মহাজনেরা। নোটবন্দির আগেই বীজ ও সার কিনে মজুত রাখায় ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছ থেকে আলুর সমস্ত কাঁচামাল পেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি চাষিদের। কিন্তু এত ঝক্কির পরেও আলুর দাম নেই। ভাল ফলনেও স্বস্তিতে নেই।
এ দিন দিলীপবাবুর মৃত্যু সংবাদ শুনেই তাঁর পড়শি চাষি কাশিনাথ সাঁতরা বলেলেন, “চাষে খরচ হয়েছিল ১৯ হাজার টাকা। এখন আলু বিকোচ্ছে ১৫০-১৭৫ টাকা প্রতি বস্তা। বিঘায় ৯০ প্যাকেট আলু হয়েছে। তবু ৫-৬ হাজার টাকা করে লোকসান। এ ভাবে কি বাঁচা যায়?” ভাটপাড়া সংলগ্ন মিরকুলি গ্রামের চাষি সৌমেন বাগ বলেন, “গত বারে প্রথম প্রথম আলুতে লাভ পেলেও পরে ব্যাপক লোকসান হয়েছিল। এ বার তো প্রথম থেকেই লোকসান।”
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy