Advertisement
০১ জুন ২০২৪

কুসংস্কারের অন্ধকার মুছতে ‘আঁধার মানুষ’

বুধবার দুপুর। ঝাড়গ্রামের ঘটিডোবা গ্রামের প্রাথমিক স্কুল প্রাঙ্গণে ‘ডাইনি’ মালতীকে পিটিয়ে মারছে চার মাতব্বর। তাই দেখে দর্শকদের মাঝে বসে থাকা শীর্ণকায় এক বৃদ্ধা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে মালতীর দেহ। লাঠিসোটা হাতে গাঁয়ের মাতব্বরেরা ফিরে গিয়েছেন।

বুধবার ঝাড়গ্রামের ঘটিডোবা গ্রামে ডাইন বিরোধী পথ নাটিকা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

বুধবার ঝাড়গ্রামের ঘটিডোবা গ্রামে ডাইন বিরোধী পথ নাটিকা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৯
Share: Save:

বুধবার দুপুর। ঝাড়গ্রামের ঘটিডোবা গ্রামের প্রাথমিক স্কুল প্রাঙ্গণে ‘ডাইনি’ মালতীকে পিটিয়ে মারছে চার মাতব্বর। তাই দেখে দর্শকদের মাঝে বসে থাকা শীর্ণকায় এক বৃদ্ধা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে মালতীর দেহ। লাঠিসোটা হাতে গাঁয়ের মাতব্বরেরা ফিরে গিয়েছেন। মায়ের দেহ আঁকড়ে বুকভাঙা কান্না নিয়ে দর্শকদের সামনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সেঁজুতি, “আমার মায়ের যে পরিণতি হল, এক দিন আপনাদের ঘরের কারোর সেই পরিণতি হতে পারে। আপনারা আর কবে জাগবেন? রুখে দাঁড়ান!” পথনাটিকাটি দেখে অশীতিপর বৃদ্ধা সুরুবালা খিলাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে বললেন, “গত মাসে আমার মেয়েটাকেও তো ডাইন বলে পিটিয়েছিল ওরা। গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল। আতঙ্কে মেয়েটা আমার বিষ খেয়ে মরল। প্রথমে ভেবেছিলাম জানগুরুর কথাই হয়তো ঠিক। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি সবটাই তো সাজানো। ডাইন বলে কিছু নেই।” সরুবালার মতো নাটক দেখতে আসা ঝাড়গ্রামের কুসুমডাঙার বেহুলা খিলাড়ি, সুমিত্রা খিলাড়িরাও বলে উঠলেন, “সত্যিই তো! কিছু ধান্দাবাজ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অসহায় মেয়েগুলোকে ডাইন সাজিয়ে খুন করে! যা দেখলাম গ্রামে ফিরে গিয়ে সবাইকে বলব।” আর এসব শুনে ঝাড়গ্রামের বিডিও অনির্বাণ বসু বলছেন, “এখানেই আমাদের সার্থকতা। ডাইনি কুপ্রথা নিয়ে মানুষজনকে সচেতন করার জন্য আমরা পথ নাটিকাকেই হাতিয়ার করেছি। সেই সঙ্গে লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতনার কাজও শুরু হয়েছে।”

মাস খানেক আগে কুসুমডাঙা গ্রামের বছর পঞ্চাশের কিরণ খিলাড়িকে এক জানগুরুর নিদানে ডাইন ঠাওরে মারধর করেছিলেন গ্রামবাসীরা। পরে কিরণ আত্মহত্যা করেন। খবর পেয়ে গ্রামে যান বিডিও। মানুষজনকে বোঝানো হয়। ওই ঘটনার পরে প্রশাসনের উদ্যোগে পথনাটিকা ও লোক সংস্কৃতির অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ডাইন বিরোধী সচেতনতার কার্যক্রম শুরু হল বুধবার। ‘স্যাডপো’ নামে একটি সংস্থা ডাইন বিরোধী ‘আঁধার মানুষ’ নামে পথনাটিকটি মঞ্চস্থ করে। পথ নাটিকা ছাড়াও ডাইন বিরোধী বিষয়ক ছৌ নাচ পরিবেশিত হয়। স্যাডপো’র পক্ষে উপল পাহাড়ি বলেন, “কুসুমডাঙা, ঘটিডোবার মতো জঙ্গলমহলের গ্রাম গুলিতে বিদ্যুত্‌ সংযোগ এসেছে। বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। কিন্তু তাঁদের মনের আঁধার দূর হয় নি। সেই আঁধার দূর করতেই আমাদের এই নাট্য-প্রয়াস।”

এ দিন ঘটিডোবা গ্রামে ওই পথানাটিকা দেখতে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের শ’দু’য়েক বাসিন্দা হাজির হন। দর্শকদের মধ্যে স্থানীয় প্রাথমিক ও হাইস্কুলের পড়ুয়ারাও ছিল। অষ্টম শ্রেণীর আলামণি হাঁসদা, দশম শ্রেণীর হরপ্রভাত মাহাতোরা বলে, “ডাইন প্রথা নিয়ে আমাদের মধ্যে নানা ভ্রান্ত ধারণা ছিল। এই নাটক দেখে শিখলাম ডাইন বলে কিছুই নেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

superstition witchcraft street drama jhargram
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE