বাড়ির দেওয়ালে বিয়ের মঙ্গলচিহ্ন এখনও মোছেনি। এরই মধ্যে এল দুঃসংবাদ। বিপর্যস্ত স্বামীহারা সুখি সরেন। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
‘পুজোর সময়ে বাড়ি গিয়ে গাড়ি ভাড়া করে ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর আর খড়্গপুরে ঠাকুর দেখতে যাব।’ রবিবার বিকেলে স্ত্রীকে ফোনে এমনটাই বলেছিলেন প্রণব। পুজোর মধ্যে স্বামী ছুটি নিয়ে আসবেন, তা জেনে বেজায় খুশি হয়েছিলেন বছর আঠারোর তরুণী সুখি সরেন। মাত্র ছ’মাস হল বিয়ে হয়েছিল তাঁর। ঠাকুর দেখতে যাওয়ার আনন্দে রবিবার বিকেলের পর থেকে আনন্দে ভরে ছিল সুখির মন। সোমবার ভোরে মোবাইলে আসা দুঃসংবাদটা এক লহমায় খানখান করে দিল সব!
পশ্চিম মেদিনীপুরের জামবনি থানার ঘন জঙ্গল ঘেরা এই হাতিকাদুয়া গ্রামে হাতে গোনা চল্লিশটি পরিবারের বাস। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সীমানা লাগোয়া এই গ্রামে চারটি আদিবাসী পরিবারের বাস। বাকি পরিবারগুলি মাহাতো সম্প্রদায়ের। তবে নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমে গ্রামের সকলের কাছে ‘গর্বের উদাহরণ’ হয়ে উঠেছিলেন বছর বাইশের যুবক প্রণব সরেন। দিনমজুর মা-বাবার ছেলে বছর দু’য়েক আগে পেয়েছিলেন হোমগার্ডের চাকরি। তাতে সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য এসেছিল। একমাত্র বোনের বিয়েও দেন। গত মার্চে নিজেও বিয়ে করেন। স্বপ্ন দেখতেন একটা মোটর বাইক কিনবেন। আর টালি-টিনের টাউনি দেওয়া মাটির বাড়িটার শ্রী ফেরাবেন।
কিন্তু ইচ্ছেপূরণ হল না! দুষ্কৃতীদের গুলিতে প্রণবের স্বপ্নেরও অপমৃত্যু হল। প্রণবের স্কুলের বন্ধু ধীরেন মাহাতোর কথায়, “স্থানীয় পরশুলি স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরে কাপগাড়ির সেবাভারতী কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন প্রণব। কিন্তু ২০১২ সালে হোমগার্ডের চাকরি পেয়ে যাওয়ায় স্নাতকস্তরে পড়া আর হয়নি।” ছুটিতে প্রণবের বাড়ি আসা মানেই গ্রামের সবার খোঁজ নেওয়া, পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে হৈ হৈ করা, আর সময় পেলে সেই ছোটবেলার মতো দেব নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার স্মৃতিতে ডুব দিচ্ছেন গ্রামের প্রৌঢ় অনিল মাহাতো, লক্ষ্মীকান্ত মাহাতোর মতো অনেকেই।
সোমবার সকালে প্রণবের মৃত্যুর খবর পেয়ে সরেন পরিবারের মাটির বাড়ির বাইরে ভিড় করেন পড়শিরা। উঠোনে লুটিয়ে কাঁদছিলেন প্রণবের মা পানমণিদেবী ও বৃদ্ধা ঠাকুমা রাইমণি সরেন। মাটির বাড়ির দেওয়ালে বিয়ের মাঙ্গলিক প্রতীক আঁকা ফুল-লতা-পাতাগুলি এখনও বিবর্ণ হয়নি। সেই দিকে তাকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছিলেন সুখি।
গ্রামবাসী জানালেন, খবর পেয়েই সকালে গাড়ি ভাড়া করে প্রণবের বাবা লাসাই সরেন ঘাটাল চলে গিয়েছেন। প্রণবের স্ত্রী সুখি বলেন, “বিয়ের পর উনি (প্রণব) চেয়েছিলেন আমি পড়াশুনা চালাই। সেই মতো এ বছর মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে কলাবিভাগে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হই। পড়াশুনার জন্য বাপের বাড়ি ওড়ো গ্রামে থাকতাম। উনি ছুটিতে এলে শ্বশুরবাড়ি আসতাম।” দিন দশেক আগে ছুটি পেয়ে স্ত্রীকে বাপের বাড়ি থেকে হাতিকাদুয়ায় এসেছিলেন প্রণব। বলেছিলেন, ‘তুমি এখন এখানেই থাকো, পুজোয় এসে সবাই মিলে আনন্দ করব।’ রবিবার বিকেলে স্ত্রীকে ফোন করে অষ্টমীর দিন বের হবেন, তা-ও জানান। কিন্তু তার আগেই প্রণব বাড়ি ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy