Advertisement
১৮ মে ২০২৪
Saree Worker

কানা গলিপথে মা, স্কুলে যায় মেয়ে

নবদ্বীপ থানার উল্টো দিকে চলে গিয়েছে ঘুপচি গলি। তারও একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। পেঁয়াজ-রসুনে কষানো মাংস, ঘুগনি, ছোলাসেদ্ধ, সেঁকা পাউরুটি, তেলেভাজা।

Birds crowding in a tree

শরতের আকাশে নেমে আসে সন্ধ্যা। কাজের অপেক্ষায় পথে ঘোরে উমারা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:১১
Share: Save:

ধরা যাক, মেয়েটির নাম পাপিয়া। ঠোঁটে ‘পোড়েনের’ রঙিন সুতো নিয়ে ‘টানার’ গলিপথে নিপুণ মাকু বুনে যেত রঙিন শাড়ি, বালুচরী। মিহি সুতোর লাবণ্যে আর জাদুকরী আঙুলের আলতো আদরে বোনা সে সব শাড়ি পিছু তখন মজুরি মিলত ৬০০ টাকা। আজ থেকে দেড় দশক আগের কথা। পাপিয়া আর তাঁর স্বামী দু’জনে দৈনিক একজোড়া বালুচরী বুনতেনই। পুজোর আগে রাত জেগে তিনটে করেও শাড়ি বুনেছেন তাঁরা। চারপাশ নতুন কাপড়ের গন্ধে ভারী হয়ে থাকত।

নবদ্বীপ থানার উল্টো দিকে চলে গিয়েছে ঘুপচি গলি। তারও একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। পেঁয়াজ-রসুনে কষানো মাংস, ঘুগনি, ছোলাসেদ্ধ, সেঁকা পাউরুটি, তেলেভাজা। সঙ্গে বিড়ি-সিগারেটের পোড়া তামাক আর উগ্র অ্যালকোহলের গন্ধ মিশে গা গুলিয়ে ওঠে। সে গন্ধের সঙ্গে পুরনো সেই নতুন সুতোর মাড়ের গন্ধের কোনও মিল খুঁজে পান না পাপিয়া। কিন্ত কয়েক বছর হল শহরের নিষিদ্ধ গলির সে গন্ধেই অভ্যস্ত হতে হয়েছে তাঁকে। সুখী সংসারের স্বপ্নভঙ্গের পর পেশাবদলে আপাতত নবদ্বীপ পুরসভার ১০ নম্বর তেলিপাড়া লেনের স্থায়ী বাসিন্দা মেয়েটি।

কপাল পুড়েছিল বছরদশেক আগে। এক দিকে স্বামী অন্য এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রাখছিলেন। পাশাপাশি, হু হু করে কমছিল হাতে বোনা তাঁতের শাড়ির মজুরি।

হাতের স্মার্টফোন আনমনে নাড়াচাড়া করতে করতে পাপিয়া বলেন, “প্রথমে খুব অশান্তি করতাম। পরে বুঝলাম, ও ভাবে কাউকে আটকে রাখা যায় না। এক সময়ে ও ছেড়ে চলে গেল। দুই মেয়ে নিয়ে একার লড়াই শুরু হল আমার।”

প্রথম দিকে আর্থিক সমস্যা ততটা হয়নি। বড় বিপদ এল আরও বছরদুয়েক পর। বাজারে যন্ত্রচালিত তাঁত এসে। হাতে বোনা কাপড়ের প্রায় সমতুল মানের শাড়ি যন্ত্র বুনতে লাগল প্রচুর পরিমাণে। কম সময়ে। মহাজন কমিয়ে দিলেন মজুরি।

পাপিয়ার কথায়, “ছ’শো টাকার মজুরি কমে হয়ে গেল দুশো টাকারও কম। কাজের পরিমাণও কমে যেতে লাগল। তত দিনে দুই মেয়ে বড় হয়েছে। ওদের দু’বেলা পেট ভরা ভাতের ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। আমার মেয়েরা কোনও দিন এত অভাবে মানুষ হয়নি। দেখলাম, এ ভাবে চলবে না।” মেয়েদের ভাল রাখতে রাস্তায় বেরোলেন।

তা-ও সাত বছর হয়ে গেল। যৌনকর্মীর পেশার সন্ধান এনেছিল তাঁরই এক পরিচিত। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে নবদ্বীপের স্থায়ী হওয়ার পর বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে স্কুলে পড়ছে।

মেয়েদের কথা বলতে গিয়ে চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মায়ের। বলেন, “আমার মায়ের কাছেই ওরা মানুষ। আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। প্রতি মাসে বাড়ি যাই। সবাই জানে, আমি পরিচারিকার কাজ করি।’’ জানালেন ওই রোজগারের পয়সায় বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। শ্বশুরবাড়িতে ভাল আছে। ছোটটির লেখাপড়ার খুব শখ। যৌনকর্মী মা বলেন, ‘‘ও যতটা পড়তে চায়, পড়বে। আমি পড়াব।”

উৎসবের দিনগুলোয় বাড়ি যাওয়া হয় না। ছোট মেয়ে পুজোয় বারবার ফোন করে। বাড়িতে ডাকে। ফোন কেটে দেন মা।

অন্ধকার গলির কোণে দাঁড়ানো পাপিয়ার তখন দু’চোখে জল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nabadwip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE