Advertisement
০১ মে ২০২৪

বছরভর পরিক্রমায় বসতে লক্ষ্মী

এক রাশ আশা নিয়ে চৈতন্যধামে এসেছেন ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থের প্রণেতা নরহরি ঠাকুর চক্রবর্তী। কিন্তু নবদ্বীপে পা দিয়ে তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হল। দেখেলেন, আমূল বদলে গিয়েছে নবদ্বীপ। ক্রমাগত ভাঙনের ফলে এক হয়ে গিয়েছে গঙ্গা ও জলঙ্গি। চারিদিক শুধু ভাঙছে।

সূচনা হল পঞ্চক্রোশী পরিক্রমা মার্গ। নবদ্বীপে তোলা নিজস্ব চিত্র।

সূচনা হল পঞ্চক্রোশী পরিক্রমা মার্গ। নবদ্বীপে তোলা নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৬ ০১:৩৯
Share: Save:

এক রাশ আশা নিয়ে চৈতন্যধামে এসেছেন ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থের প্রণেতা নরহরি ঠাকুর চক্রবর্তী। কিন্তু নবদ্বীপে পা দিয়ে তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হল। দেখেলেন, আমূল বদলে গিয়েছে নবদ্বীপ। ক্রমাগত ভাঙনের ফলে এক হয়ে গিয়েছে গঙ্গা ও জলঙ্গি। চারিদিক শুধু ভাঙছে। প্রমাদ গুনলেন নরহরি। বুঝলেন দ্রুত একটা ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই হয়তো গঙ্গায় তলিয়ে যাবে চৈতন্যস্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি। পায়ে হেঁটে নবদ্বীপ ও সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখলেন সব মিলিয়ে ষোল ক্রোশ পথ হাঁটলেই চৈতন্যদেবের নবদ্বীপ পর্বের সব ক’টি স্থান ছুঁয়ে আসা যায়। ঠিক যে ভাবে চৈতন্যদেব, বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলির পুনরুদ্ধারে চুরাশি ক্রোশ পরিক্রমার সূচনা করেছিলেন, নরহরি সেই একই পথে হেঁটে সূচনা করলেন নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমার। উদ্দেশ্য একটিই। নিয়মিত ভক্ত সমাগমে চৈতন্যস্মৃতিগুলি যাতে সুরক্ষিত থাকে। নরহরি চক্রবর্তীর সেই চেষ্টা বিফলে যায়নি। সেই ১৭৬০ সালে নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমা প্রচলিত চৈতন্যধামে।

তেরো পার্বণের শহর নবদ্বীপ এমনিতে পালপার্বণ নিয়েই বাঁচে। এই শহরের ভালমন্দের সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক খুব নিবিড় এবং গভীর। বৈশাখ থেকে চৈত্র – নবদ্বীপের নিজস্ব উৎসব ক্যালেন্ডারে কোনও না কোনও উৎসব লেগেই আছে। শিল্প কারখানাহীন এ শহরের অর্থনীতি ভীষণ ভাবেই উৎসব ও পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। উৎসবের টানে এ শহরে বারোমাস দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। শ্রীচৈতন্যদেবের নবদ্বীপে থাকাকালীন সময়ের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলিতে সংকীর্তন সহযোগে পদব্রজে অন্তত একবার পৌঁছনো বৈষ্ণব ভক্তরা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করেন। চৈতন্যস্মৃতি বিজড়িত বৃহত্তর নবদ্বীপকে ছুঁয়ে এই পথচলার পোশাকি নাম “নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমা”। কিন্তু এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষই পরিক্রমার জন্য বেছে নেন মূলত দোল, রাস বা নিয়মসেবার মাস। তখন গঙ্গার দু’পাড়ের সমস্ত মঠমন্দির তাদের মতো করে পৃথক ভাবে আয়োজন করে পরিক্রমার। দোলের সময়ে পরিক্রমায় বিপুল জন সমাগমের প্রভাব দারুণ ভাবে পড়ে নবদ্বীপের স্থানীয় অর্থনীতিতে।

সেই পরিক্রমা যাতে পঞ্জিকা নির্ধারিত তিথি-নক্ষত্রে আটকে না থেকে বারোমাসই শহরের অর্থনীতির পুষ্টিসাধন করে সেই উদ্দেশে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ, সনাতন সন্ত সমাজ ও চৈতন্য ভাবনামৃত সেবাশ্রম। এই পরিক্রমা যাতে বারোমাস ধরে একটি নির্দিষ্ট পথ ধরে হয় তার জন্য ‘পঞ্চক্রোশী পরিক্রমা মার্গ’ চিহ্নিত করে শনিবার সকালে সেই পথে নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমার নতুন অধ্যায় শুরু করলেন নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠমন্দিরের প্রধানেরা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের তরফে কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী জানান, ‘‘এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নবদ্বীপ ঘুরে পনেরো কিমি পথকে পরিক্রমার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। পঞ্চক্রোশী মার্গের মোট তিরিশটি জায়গায় লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে পথ নির্দেশক ফলক বসানো হয়েছে। এখন থেকে সারা বছর দিনের যে কোনও সময়ে পরিক্রমা করতে পারবেন ভক্তেরা।’’

‘পঞ্চক্রোশ পরিক্রমা মার্গ’ প্রসঙ্গে নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস মহারাজ বলেন, “এমন একটি পরিকল্পনা নিয়েছি যাতে পর্যটকেরা সারা বছর নবদ্বীপে আসবেন এবং পরিক্রমায় বেরোবেন তাঁদের নিজের মতো করে।’’ তাঁর দাবি, এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও অর্থনীতির সঙ্গে তার যোগ ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। মহাপ্রভুর জন্মভূমি শ্রীধাম নবদ্বীপে একটি বার পা রাখার জন্য তাবৎ পৃথিবীর বৈষ্ণব ভক্তেরা ব্যকুল। তাই সারা বছর যদি পরিক্রমার ব্যবস্থা থাকে তা হলে নবদ্বীপের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সহ সভাপতি কিশোর কৃষ্ণ গোস্বামী জানান, দোল বা অনান্য উৎসবের সময়ে যে নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমার প্রথা চালু আছে সেখানে দীর্ঘপথ পরিক্রমা করতে হয়। চৈতন্য জন্মস্থান প্রাচীন মায়াপুর থেকে শুরু করে বিদ্যানগর, জাহান্নগর, বেলপুকুর, হরিহরক্ষেত্রের মতো নবদ্বীপ এবং লাগোয়া বর্ধমানের চৈতন্যস্মৃতি বিজড়িত স্থানে দোলের পনেরো দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় এই পরিক্রমা। ওই দীর্ঘপথ অনেকের পক্ষেই পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয় না। বৃন্দাবনে যেমন ৮৪ ক্রোশের পাশাপাশি পঞ্চক্রোশ পরিক্রমার ব্যবস্থা আছে, তেমনি নবদ্বীপেও মহাপ্রভু মন্দিরকে কেন্দ্র করে একটি পঞ্চক্রোশী পরিক্রমা বৈষ্ণব ভক্তদের মধ্যে প্রচলিত আছে। কিন্তু সেই পরিক্রমা নবদ্বীপে কোনও নির্দিষ্ট পথ মেনে হয় না। তিনি বলেন, “সে জন্য একটি পঞ্চক্রোশ পরিক্রমা মার্গ চিহ্নিত করা হয়েছে। যাতে বছরভর ভক্তেরা পরিক্রমা করতে পারবেন।’’ তিনি জানান, কোনও মঠমন্দিরের ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল হতে হবে না। নবদ্বীপ পুরসভা-সহ স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। পরিক্রমা মার্গ জুড়ে থাকছে পথ নির্দেশক চিহ্ন। ওই নির্দিষ্ট মার্গ ধরে বছরভর ধারাবাহিক পরিক্রমা চৈতন্যচর্চার পাশাপাশি নবদ্বীপের বাণিজ্যকেও প্রসারিত করবে।”

এ প্রসঙ্গে নবদ্বীপ সনাতন সন্ত সমাজের সম্পাদক নিত্যযুক্তানন্দ অবধূত বলেন, “হাজার বছরের প্রাচীন শহর নবদ্বীপে সঙ্গে বৌদ্ধ, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব সব মতের মেলবন্ধন ঘটেছে নবদ্বীপে। সুতরাং এখানে মানুষ আসবেন ভক্তিবাদের প্রবাহে ভাসবেন এটাই স্বাভাবিক। ভক্তদের নিত্য যাতায়াতে স্থানীয় মানুষের জীবন জীবিকা সমৃদ্ধ হোক, এটাই আমরা চাই। নির্দিষ্ট পথে নিয়মিত পরিক্রমায় সুনিশ্চিত ভাবেই নবদ্বীপের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।”

বছর ভর পরিক্রমার উদ্যোগে খুশি স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল। বছরভর পঞ্চক্রোশী পরিক্রমার সুবাদে সারা বছর ধরেই যদি দোলের অর্ধেক লোকও যাতায়াত করেন, তা হলেই যথেষ্ট। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলেন, “চমৎকার উদ্যোগ। সারা বছর ধরে মানুষ আসবেন নির্দিষ্ট পথে পরিক্রমা করবেন, শহরে রাত্রিবাস করবেন সব মিলিয়ে বারোমাসই বাণিজ্যের একটা চক্রাকার প্রবাহ থাকবে। এই পরিক্রমা যত বেশি মানুষ করবেন ততই নবদ্বীপের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে, যার ফসল ঘরে তুলতে পারবেন নবদ্বীপের সব শ্রেণির ব্যবসায়ী।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

state news nabadip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE