মাঠে এ ভাবে বসানো হয়েছে ট্রান্সফর্মার। — নিজস্ব চিত্র
যত দূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত আধ-পাকা ধান খেত। মাঝে মধ্যে বাঁশের খুঁটির মাচায় কোনওক্রমে ঠেলে তোলা ট্রান্সফর্মার। কোথাও আবার ট্রান্সফর্মার পাকাপাকি বসানো গরুর গাড়িতে। হাইভোল্টেজ বিদ্যুতের তার থেকে হুকিং করে জোড়া হয়েছে সেই ট্রান্সফর্মারে। যার শেষ প্রান্তে ধকধক করে চলছে সাবমার্সিবেল পাম্প। মাটির গভীর থেকে সেই পাম্প টেনে তুলছে জল। আঁকাভাঁকা নালা বেয়ে তা ধেয়ে চলেছে পাকা ধান খেতে। বোরো চাষ সবুজ হয়ে আছে মাঠ।
এটাই নিয়ম এটাই চল। রাজ্যের বিদ্যুৎ বণ্টন দফতরের মুর্শিদাবাদ জেলার এক পদস্থ কর্তা বলছেন, ‘‘জেলা চাষিদের ‘আপন’ ট্রান্সফর্মারে হুকিংয়ের বিদ্যুতে ধানি মাঠে এখন রমরমা, এটাই এ জেলায় দস্তুর!’’
হাসতে হাসতে নবগ্রামের এক চাষি বলছেন, ‘‘এ ছাড়া উপায় কী, হা পিত্যেশ করে বসে থাকলেও তেনারা (পড়ুন বিদ্যুৎ বণ্টন দফতর) আর সংযোগ দিচ্ছেন কোথায়?’’
বিল বসিয়ার মতো প্রত্যন্ত এলাকায় পা দিলে তা চোখে পড়ছে। বর্ষার সময় চার দিকে সেখানে জল। ফলে ওই এলাকায় চাষের তেমন চল নেই। কিন্তু বর্যা পেরোলে শুকিয়ে খটখটে সে বিল। বোরোচাষের জন্য ওই দিগড়ে ভরসা তখন সাবমার্সিবল পাম্প। কিন্তু পাম্প বসাতে সরকারি অনুমতি ও পাম্প চালাতে অস্থায়ী বিদ্যুত সংযোগ পেতে বড় হ্যাপা, জানাচ্ছেন চাষিরাই।
তাই সহজ উপায়, মাইল খানেক দূর থেকে ৪০-৫০টি বাঁশের খুঁটি পুঁতে হাইভোল্টেজ লাইন থেকে তার জুড়ে হুকিং করে আনা হয়েছে বিদ্যুৎ। তাতেই দিব্যি চলছে বোরোচাষ।
উপরের দু’টি উদাহরণ নয়, জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখলে চোখে পড়বে এমনই হাজারো বিদ্যুৎচুরির ঘটনা। কোথাও বিদ্যুৎ চুরি করে চলছে সান্ধ্য আড্ডা, কোথাও ক্লাবঘরে টিভি চালিয়ে ক্রিকেট-দর্শন।
জেলা বিদ্যুৎ ভবনের এক কর্তা বলেন, ‘‘এ জেলার বিদ্যুৎচুরি ব্যাপক হারে বেড়েছে। এতটাই যে, বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে ট্রান্সফর্মারও দাবি করার রেওয়াজ রয়েছে!’’
যদিও জেলার বিদ্যুৎ চুরি বন্ধের সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত আঞ্চলিক ম্যানেজার পার্থপ্রতিম দত্তের দাবি, ‘‘কই, তেমন কিছু তো নজরে পড়ছে না।’’ বিদ্যুৎ চুরি রুখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা অবশ্য মেনে নিচ্ছেন তিনি। কিন্তু সেই ‘চেষ্টা’ যে যথেষ্ঠ নয়, তা জেলা পরিষদের বিদ্যুৎ কর্মাধ্যক্ষ আব্দুর রহমান শেখের কথায় স্পষ্ট, ‘‘সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, জেলায় শতকরা ৫৪ ভাগ বিদ্যুৎ চুরি হয়।’’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে পার্থপ্রতিমবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘এ নিয়ে জানতে হলে কলকাতায় বিদ্যুৎ ভবনের কর্পোরেট বিভাগে খোঁজ করুন। আমার কাছে কোনও তথ্য নেই।’’
এত চুরির মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে বিদ্যুৎ দফতরের কান্দি বিভাগ। জেলায় বিদ্যুৎ দফতর কান্দি, ডোমকল, জিয়াগঞ্জ, রঘুনাথগঞ্জ ও বহরমপুর ভাগে বিভক্ত। কান্দি বিভাগের মধ্যে রয়েছে সাতটি সাপ্লাই স্টেশন— গোকর্ণ, গোয়ালজান, মাড়গ্রাম, পাঁচথুপি, ভরতপুর, সালার ও কান্দি। কান্দি বিদ্যুৎ বিভাগের স্পেশাল অফিসার জসিমুদ্দিন শেখের নেতৃত্বে অভিযান শুরু হয়। জেলা বিদ্যুৎ দফতর সূত্রের খবর, অভিযান চালিয়ে গত বছরের অগস্ট মাস থেকে এ বছরের ৬ মে পর্যন্ত মোট ৭ মাসে ৩১৮ জনের বিরুদ্ধে ২১৫টি মামলা রুজু করা হয়েছে। আদায় হয়েছে ৮১ লক্ষ টাকা জরিমানা। কিন্তু এতো মরুভূমিতে এক টুকরো মরুদ্যানের মতো। জেলায় কবে বিদ্যুৎচুরিতে লাগাম পড়বে জানেন না কেউ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy